জাতীয়
এবার ফাঁসতে পারেন ফেনীর এসপিও
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রের আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ফেঁসে যেতে পারেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার। পুলিশ সদর দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে এমন আভাস দিয়েছেন। তারা জানান, সোনাগাজী মডেল থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষ নেওয়ায় ফাঁসতে পারেন ফেনীর এসপি। তিনি পুলিশ সদর দপ্তর, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) দপ্তরে কেন চিঠি পাঠিয়েছেন, কেন নুসরাতের পরিবারকে দোষারোপ করেছেন, তার কৈফিয়তও জানতে চাওয়া হবে।
মাদ্রাসাছাত্রী হত্যার ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকাল বুধবার সরেজমিনে ঘটনাস্থল মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টার পরিদর্শনে যান।
ওই কমিটির প্রধান ও পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড প্ল্যানিং) এস এম রুহুল আমিন গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আজ (গতকাল) ফেনীতে এসে কাজ শুরু করেছি। সবার সঙ্গে কথা বলব। সোনাগাজী থানার ওসির গাফিলতি কতটুকু ছিল, তা-ও উদঘাটন করা হবে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হবে।
ফেনীর পুলিশ সুপার কেন রাফির পরিবারকে দোষারোপ করে চিঠি দিয়েছেন, সেজন্য তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কারও গাফিলতির প্রমাণ মিললে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিবেদনের আলোকে পুলিশ সদর দপ্তর পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।’
পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের আসামিদের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ ওঠে বেশি। ঘটনার পর তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাছাড়া নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে ভিডিও করার অপরাধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে মামলা হয়েছে। পুলিশের গাফিলতির অভিযোগ ওঠায় সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পাঁচ সদস্যের একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির প্রধান করা হয় ডিআইজি এস এম রুহুল আমিনকে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সিআইডির একজন পুলিশ সুপার, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সম্রাট মো. আবু সুফিয়ান ও পরিদর্শক সালাউদ্দিন আহমেদ।
তদন্ত কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঘটনার আগে ও পরে কী ঘটেছে, তা উদঘাটন করার চেষ্টা করা হবে। সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসিসহ সব কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বিশেষ করে ওসিকে বেশি জেরা করা হবে। রাফিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওসির সঙ্গে আর কোন কোন পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিল, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ওই দিন বাইরের কেউ উপস্থিত ছিল কি না, তা খুঁজে বের করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাফির পরিবারের সঙ্গে কথা বলব। মাদ্রাসার অন্য শিক্ষক ও ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হবে।
এর আগে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আর কোনো ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক ঘটনা ঘটিয়েছিল কি না, তাও বের করা হবে। পুলিশ সুপার কেন ওসির পক্ষে ওকালতি করেছেন সেজন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে এসপি এইভাবে চিঠি লিখতে পারেন না। এজন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আজ (বুধবার) ও কাল (বৃহস্পতিবার) ফেনীতে অবস্থান করব। তবে কাজ শেষ না হলে আরও কয়েক দিন থাকতে হবে। আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন আইজিপি স্যারের কাছে জমা দেওয়া হবে বলে আশা করছি। তার আগে মিডিয়া ব্রিফ করা হতে পারে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফেনীর এসপি সরাসরি রাফির পরিবারকে দায়ী করতে পারেন না। চিঠি লেখার আগে বর্তমান পরিস্থিতি তার উপলব্ধি করা উচিত ছিল। ওসির সঙ্গে তিনি ফেঁসেও যেতে পারেন। তাকে বদলি করা হতে পারে। এমনতিতেই তার বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ আছে। স্থানীয় সাংসদ নিজাম হাজারীর পক্ষ নিয়ে এসপি কাজ করেন বলে পুলিশ সদর দপ্তরে তথ্য এসেছে।’ গত ১১ এপ্রিল এসপি চিঠিটি পাঠান।
ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, চিঠিতে জাহাঙ্গীর অভিযোগ করেন, নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মামলা করতে পরিবার কালক্ষেপণ করেছে। ঘটনার দিন নুসরাত পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় যান। এরপর তার বসার স্থানে ফাইলপত্র রেখে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদের ওপরে শৌচাগারের কাছে যান। কিছুক্ষণ পর গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে আসেন। এই সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ও মাদ্রাসার কর্মচারীরা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তারা মামলা করতে কালক্ষেপণ করে। পুলিশ নুসরাতের চাচাকে বাদী করে মামলা করতে গেলে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান আপত্তি জানান। তিনি দুবার এজাহার বদল করেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি পাঁচজন অংশ নেয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা স্বীকার করেছেন, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশেই তারা নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে ফেনীর এসপি জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কয়েক দফা মোবাইলে ফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।