Uncategorized
চেন অব কমান্ড নেই ছাত্রদলে, নতুন কমিটি চান তরুণ নেতারা
চেন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে। জেলা, উপজেলা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগর কমিটিতে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। পদ-পদবির মতবিরোধের কারণে নেতারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি অতীতে। আর এ কারণে একাদশ নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে পারেনি সংগঠনটি। এখন নতুন কমিটি চান তরুণ নেতারা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চান ত্যাগীরা কমিটিতে স্থান পাক। কিন্তু হাঙ্গামার ভয়ে কমিটি দিচ্ছে না বিএনপি।
বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত হয়নি। ডাকসু নির্বাচনের আগে নতুন কমিটি করার পক্ষে ছিলেন একটি পক্ষ। তখন অন্য পক্ষ বলছে, ডাকসু নির্বাচনের আগে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ করা হোক। সেসময় ছাত্রংদলের কমিটি গঠনে বিরত ছিলেন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনুরোধের ফলে। কিন্তু দেখা দেছে ডাকসু নির্বাচনে কোনো ধরনের সাফল্য দেখাতে পারেনি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তবে কাউন্সিলের মাধ্যমে ছাত্রদলের দ্রুত নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি চান সংগঠনটির কেন্দ্রীয়ও তৃণমূল নেতারা। অন্যদিকে ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনে বিএনপির হাইকমান্ড এখনো তৎপর রয়েছে। খুব দ্রুতই নতুন কমিটি গঠন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা।
২০১৪ সালে ঘোষিত ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। রাজীব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর ছাত্রদলের ১৫৩ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে ৭৪৩ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। ওই বছরের ১৪ অক্টোবর এই কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। এরপর গত ৫ বছরেও নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বর্তমান সময়ে সাংগঠনিক কার্যক্রমেও ছাত্রদল বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারেনি। বরং নেতৃত্ব দ্ব›দ্ব এবং ক্ষমতার কোন্দলে নিজেদের মধ্যেই একাধিকবার বিবাদে জড়িয়েছেন এই ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
মেয়াদোত্তীর্ণ বর্তমান কমিটি নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একাধিক নেতার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা মানবকণ্ঠকে বলেন, মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর গত ৫ বছর কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো সমন্বয় সভা হয়নি। এ ছাড়া জেলা কমিটি গঠনে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে আগের মতো টিমও গঠন করা হয়নি। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই ছিলেন সর্বেসর্বা। তাদের হাতেই ছিল সংগঠনের চাবিকাঠি। অন্য নেতারা ছিলে সে ফ অলঙ্কার হিসেবে। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে নেতাকর্মীর মধ্যেও।
অপরদিকে কমিটি গঠন না করায় দীর্ঘদিন ধরে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটিতে। পদপ্রত্যাশী একাধিক নেতার দাবি, কমিটি আটকে রাখায় অনেক উদীয়মান ছাত্রনেতা ঝরে পড়েছেন। হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকে। এর ফলেই সরকারবিরোধী কোনো কার্যক্রমে রাজপথে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি ছাত্রদল। এর খেসারত গুনতে হচ্ছে বিএনপিকেও। বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী এ প্রসঙ্গে জানান, শিগগিরই ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করা প্রয়োজন বলে দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে জেলে যাবার আগে অবহিত করা হয়েছে। তিনি বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন বলেও দাবি করেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এ্যানী। তিনি আরো বলেন, শিগগিরই নতুন কমিটি হবে। গত ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের সমাবেশে ম্যাডামের (খালেদা জিয়ার) বক্তব্যে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে জানান তিনি। আর ত্যাগী ও দক্ষদের মূল্যায়ন করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন সেই সময়। এমনটিই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক এ্যানি।
অন্যদিকে নতুন কমিটি গঠনের গুঞ্জন শুরু হতে না হতেই আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছেন পদপ্রত্যাশী নেতারা। এখন অপেক্ষাকৃত ‘কম বয়সী’র হাতে ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্ব দিতে চান বিএনপির হাইকমান্ড। সম্প্রতি বিএনপি ও ছাত্রদলের একাধিক শীর্ষ নেতার সাথে কথা বলে এসব জানা গেছে। কেননা নতুন কমিটি হচ্ছে, হবে করেও অপেক্ষার শেষ নেই ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের। নতুন কমিটি হচ্ছে- হবে করেই দুই বছর মেয়াদের কমিটি পাঁচ বছরে পা রেখেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ওপর সংগঠনের শীর্ষ অনেক নেতা অনাস্থা জানিয়েছেন অনেক আগেই।
বিএনপির প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত ছাত্রদলের নতুন কমিটি না হওয়ায় পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের মাঝে যেমন হতাশা ও চাপা ক্ষোভ বাড়ছে তেমনি নতুন কর্মী-সমর্থকও হারাচ্ছে সংগঠনটি। নতুন কমিটি গঠনের একটি সম্ভাবনা তৈরি হলেও অদৃশ্য কারণে তা ঝুলে গেছে। প্রায় দুই মাস আগে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানসহ সিনিয়র কয়েকজন নেতা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সাথে নয়াপল্টন কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করে নতুন কমিটি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। প্রত্যুত্তরে বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা আশ্বাসও দিয়েছেন।
অন্যদিকে ২ বছরের কমিটি ৫ বছর পার। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। গত বছরের ১ জানুয়ারি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখেও নতুন কমিটির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন ছাত্রদলের নেতারা। বর্তমান কমিটির বেশির ভাগ নেতার ছাত্রত্ব না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে এ কমিটি গঠনের পর থেকেই ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। বর্তমান কমিটির শীর্ষ তিনজন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে পদ পেয়েছেন। সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী হওয়ার জন্য জোর লবিংও করেন ছাত্রদলের শীর্ষ তিন নেতা। এসব কারণেই ছাত্রদল নেতারা সর্বস্তরে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন।
এদিকে ছাত্রলীগের চেয়ে পিছিয়ে ছাত্রদল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের চেয়ে কমিটি গঠনের ধারাবাহিকতায় পিছিয়ে আছে সংগঠনটি। ২০১৪ সালে ছাত্রদলের কমিটি হওয়ার পর ছাত্রলীগের দুটি নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন হয়েছে। কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে ছাত্রদল। এ নিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রশ্ন তুলে ছাত্রদলকে গতিশীল করার কথা বলছেন।
অপরদিকে ছাত্রদলের নতুন কমিটির শীর্ষ পদ পেতে আগ্রহী ছাত্রদলের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, গঠনতন্ত্র মোতাবেক নতুন কমিটি না হলে পদপ্রত্যাশীদের মাঝে অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি হবে। সুতরাং আগামীদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের উচিত দ্রুত ছাত্রদলের নতুন কমিটি করা।
অন্যদিকে শীর্ষ পদপ্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে গেছে। ছাত্রদলের সম্ভাব্য নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে চেষ্টা করছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই। এদের মধ্যে রয়েছেন নাজমুল হাসান, আলমগীর হাসান সোহান, আব্দুল ওহাব, আবু আতিক আল হাসান মিন্টু, সাবেক ঢাবি ছাত্রনেতা নাহিদুল ইসলাম সুহাদ, ইখতিয়ার কবির, মামুন বিল্লাহ, জহিরুল ইসলাম বিপ্লব, আসাদুজ্জামান আসাদ, মফিজুর রহমান আশিক, বায়েজীদ আরেফিন অন্যতম। এর বাইরেও শীর্ষ পদের জন্য চেষ্টা করছেন কাজী মোক্তার হোসেন, মেহবুব মাসুম শান্ত, মিনহাজুল ইসলাম ভূঁইয়া ও আরজ আলী শান্ত প্রমুখ। পদপ্রত্যাশীদের অনেকেই মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলায় জেলও খেটেছেন।
ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক বায়েজীদ আরেফিন বলেন, সারা দেশে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা প্রতি দুই বছর বা আড়াই বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় নতুন নেতৃত্বের অধীনে কাজ করতে অভ্যস্ত। তাই আগে দরকার কেন্দ্রে গতিশীল নতুন নেতৃত্ব। তা না হলে আবার ছাত্রদলের ভ‚মিকা প্রশ্নের মুখে পড়বে। ছাত্রদলের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা বলেন, ছাত্রদল হচ্ছে বিএনপির প্রবেশদ্বার। ছাত্রদলের নেতৃত্বেই আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব হয়েছিল। ছাত্রদলের আগামী নেতৃত্বের জন্য বিএনপির হাইকমান্ড তৎপর রয়েছে। তাদের নির্দেশ মতো সম্ভাব্য ছাত্রনেতাদের তালিকা যাচাই-বাছাইও হয়েছে।
বিষয়টি দেখছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার সময়ের ব্যাপার বলে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। একই সঙ্গে রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় থাকবে এমন ত্যাগী নেতাদের হাতে নেতৃত্বে দিতে তারেক রহমান বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদেরকে আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কয়েকজন মানবকণ্ঠকে জানিয়েছেন, কমিটি ঘোষণা দেয়ার পর অনেকে হাঙ্গামায় লিপ্ত হবে।
এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সুবিধা নিতে পারে। সে কারণে কমিটি দিতে দেরি হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির একজন শীর্ষ নেতা জানান, আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রদলকে মাঠে পাওয়া যায় না। কাক্ষিত পদ না পেলে আবার বিশৃঙ্খলা করবে। সে জন্য বিএনপির হাইকমান্ড মনে করছে ধীরে সুস্থে কমিটি দেয়া হবে। এ নেতা আরো বলেন, একই অবস্থা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের। তারাও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করছে অনেক পরে। আমরাও সেই পথে হাঁটছি।
সূত্র: ডিএম/মান