Scroll
পাশ্চাত্যের ভ্যালেন্টাইন্স ডে আমাদের জন্যে নয় কেন…?
হেনরী স্বপন:
ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস প্রায় দরজার কাছে কড়া নাড়ছে। আর এরই মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে প্রেম উদযাপনের সপ্তাহ। ৭ ফেব্রুয়ারি হতে রোজ ডে’র মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে এবং আমাদের দেশেও উৎসবটি আজকাল মহাসমারোহে পালিত হয়।
আমাদের ছেলেবেলায় ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উৎসব নিয়ে আমাদের কোনই উৎসাহ ছিলো না। ফেসবুক, টুইটার, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের এই উৎসবটি এখন আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এই দিবসের আখ্যান সম্পর্কে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ভাষ্য হচ্ছে : দিবসটি লুপারকালিয়া বলে প্রাচীন রোমের একটি নিজস্ব উৎসব ছিলো মাত্র। ফেব্রুযারির ১৩ থেকে ১৫ তারিখ অবধি সেখানকার নারী-পুরুষ সকলেই প্রচুর মদ্যপান করে একে-অন্যের জন্য লটারীর মাধ্যমে সঙ্গমের জন্য সঙ্গী বেছে নেয়ার সেই উৎসবই আজ সারা বিশ্বে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পরিণত হয়েছে।
মধ্যযুগের ইংরেজ কবি জেফ্রি চশার, আর উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ভ্যালেন্টাইন্স ডে’কে রোমান্টিক দিন হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এ নিয়ে তারা উভয়েই গদ্য/পদ্যও রচনা করেছেন। চশার ও শেক্সপিয়ার যদি ভ্যালেন্টাইন্স ডে’কে রোমান্টিক আখ্যা না দিতেন? তাহলে হয়তো, ন্যাংটো হয়ে মেয়েদের ওপর নির্যাতন করার এই প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক উৎসবটিকে এভাবে ‘রোমান্টিক’ বা প্রেমের দিন হিসেবে পালন করা হতো না। কারণ, মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রোমের যে দুজন ভ্যালেন্টাইন নামের সন্তকে মেরে ফেলা হয়েছিল, তাদের কেউই কিন্তু রোমান্টিক লোক ছিলেন না। রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াস রোমের সৈন্যদের বিয়ে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন, “বিবাহিত পুরুষেরা ভালো সৈন্য হওয়ার উপযুক্ত নয়। কিন্তু রোমের এক পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ইতিহাস বলে, ২৬৯ সালে সেন্ট জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন্স নামে একজন পাদ্রি চিকিৎসক খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের অভিযোগে গ্রেফতার হন। বন্দী থেকেই তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। তাদের দু’জনের মধ্যে এক সময় প্রেমের সম্পর্কও গড়ে ওঠে। এই ঘটনা চাউর হলেÑ সেই চিকিৎসক ভ্যালেইটাইন তখন রোমে প্রচ- জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ফলে, সম্রাট তখন ঈর্ষান্বিত হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেইটাইনের মৃত্যুদ- দেন। মৃত্যুর আগে সেন্ট জুলিয়াস প্রেমিকার উদ্দেশ্যে একটি চিঠির শেষ ছত্রে লিখেছিলেন, ‘ফ্রম ইয়র ভ্যালেন্টাইন্স’। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন্স স্মরণে ‘১৪ ফেবুুয়ারি’ ভ্যালেন্টাইন্স দিবস ঘোষণা করেন। সেই থেকেই দেশে দেশে সর্বত্র এই উৎসবের শুরু হতে থাকে।
আজও একবিংশ শতাব্দীতে! ভ্যালেন্টাইন্সের নামে এই দিবসটি এখন ব্যবসায়ীদের জন্য বিশাল প্রফিটাবেল দিন। এ উপলক্ষ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে। আর ভালবাসার নামে নানা উপহার ক্যান্ডি, ফুল, কার্ড আর ডিনার বিক্রির অন্যতম দিন এটি। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্ম দিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। তাই, এইসব উৎসবে গির্জা অভ্যন্তরেও খ্রিস্টভক্তরা মদ্যপানে বিরত না থাকার জন্য এবং খ্রিস্টীয় চেতনা ভ্যালেন্টাইন্সের কারণে বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার তাদের দেশে ভ্যালেন্টাইন্স উৎসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিক ভাবে এ দিবস উৎযাপন করা নিষিদ্ধ করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতেও বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি জনগণের আক্রোশে ও সরকারিভাবেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। ঠিক একই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র বিপক্ষে হিন্দু এবং মুসলমান মৌলবাদিরা বেশ সরব। তারাও মনে করে এই দিবসটি আমাদের সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকা-। ধর্মকানা মৌলবাদীদের এইসব চিন্তা দেখে, আশ্চর্য লাগে, প্রেম কি সংস্কৃতির অংশ নয়? যে সংস্কৃতিতে প্রেম নেই, সেই সংস্কৃতিই তো অপসংস্কৃতি? যারা প্রেম দিবসের বিরুদ্ধে মিছিল করে, তারা কি কখনও ধর্ষণের বিরুদ্ধে, ঘৃণা আর বর্বরতার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে কখনো? নিশ্চিত! তারা এটা করেননি কখনোই।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উৎস যত কুৎসিতই হোক, যত বর্বরই হোক, যত উদ্ভট হোক, দিনটি নিয়ে ব্যবসায়ীরা যত ব্যবসা করুক না কেন? আমি বুঝি: দিনটির সঙ্গে ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। ব্যাস! ভালবাসা মনেই ভাল কিছু। মানুষ তো ইতিহাস জানে না, সে কারণেই দিনটিকে নিখাঁদ ভালোবাসার দিন হিসেবেই বিচার করছেÑ না হয় করুক? চারদিকে যখন এতো ঘৃণা আর অবিশ্বাস। চারদিকে যখন স্বার্থপরতা আর হিংসে, চারদিকে যখন যুদ্ধ আর অশান্তিÑ তখন কোনো এক নামে যদি? কোনো এক দিবস ভালোবাসাকে উপজীব্য করে আসে, যে দিবস মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসাÑ স্নেহÑশ্র্রদ্ধার সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, এরচেয়ে সুখবর আর কী আছেÑ এই পৃথিবীতে?
মানুষ জন্মেই শিখে যাচ্ছে? কী করে নিজের জন্য সবকিছু বাগিয়ে নিতে হয়। ছলেবলে কৌশলে মানুষ শুধু নিতে শিখেছে। তাহলে, ভ্যালেন্টাইন্স নামের একটি দিন এসে যদি আমাদের অন্তরে কিছুটা ভালবাসা শেখায়, ক্ষতি কী? ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিনই তো হিংসা-বিদ্বেষ নিয়ে আছি আমরা। বছরের একটি দিনেও যদি নিখুঁত ভালবাসার চর্চা হয়, হোক না? তাছাড়া, দিবসটির বিবর্তনও ঘটছে? সেই আদিকাল থেকে। আজ মানুষ শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাকে নয়, বাবা-মা, ভাই-বন্ধু এবং পোষা কুকুর-বেড়ালকেও হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স জানাচ্ছে।
পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করার আর তো, সময়-সুযোগ নেই কারোর। যদিও আমি মনে করি, ভালোবাসা এক দিনের জন্য নয়, ভালোবাসা নিত্যদিনের জন্যই হওয়া উচিৎ। আমি তেমনই ভালবাসায় বিশ্বাসি হতে চাই আজন্মকাল। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপন করি না, কিন্তু সমাজটা যেহেতু স্বার্থান্ধ! তাই, আমিও চাই : এই সমাজটা নিরঙ্কুশ ভালোবাসা শিখুক; ভালোবাসার চর্চা করুক।
ঘৃণা প্রদর্শন নিয়ে জড়তা নেই আমাদের, কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে যেহেতু জড়তা আছে, চাই আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষের জন্য মানুষ ভালোবাসা প্রকাশ করুক। মানুষ প্রকাশ্যে মানুষকে চড় নয়, কিল-ঘুঁষি নয়, লাথি নয়, বরং চুমু খাক একে অন্যকে ভালোবেসে। একটি দিন ভালোবাসার চর্চা করলে মানুষ প্রকাশ্যে প্রেম করাকে আর চুমু খাওয়াকে মন্দ বলে ভাববে না, নিষিদ্ধ বলে ভয় পাবে না, মানুষের দ্বিধা কেটে যাবে। আজকের এই দিনে ভায়োলেন্স নিষিদ্ধ হোক। নারীর ওপর নির্যাতন অন্তত একটি দিনের জন্য হলেও বন্ধ করবে কি এদেশের পুরুষতন্ত্র? সমাজের ভায়োলেন্স অন্তত বছরের একটি দিনে না করুক সবাই। ভ্যালেন্টাইন দিবসে যদি ভায়োলেন্স বন্ধ না হয়, তাহলে, এই ভ্যালেন্টাইন্স দিবস পালনের কোনো মানেই নেই। তাই, আমরা এই দিবসের শিক্ষা থেকে মানুষকে ভালোবাসতে না পারি, অন্তত ঘৃণা যেনো না করি। আমরা অন্তত আমাদের প্রিয়জনদের একটি ফুল দিতে না পারলেও, তাকে যেনো কাঁটা দিতে উদ্যত না হই। চুমু খেতে না পারলেও, অন্তত চড়-ঘুঁষি মারা থেকে যেনো বিরত থাকতে শিখি। আমাদের সমাজের আহরহ সমস্ত ভায়োলেন্স বন্ধ না করলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করার অধিকারই হয়তো পুরুষের থাকা উচিত নয়! ভ্যালেন্টাইন্স ডে যেনো অবাধ যৌনাচার এবং একটি মেয়েকেও যেনো যৌনদাসী হতে না হয়, একটি মেয়েকেও যেনো কখনোই পুরুষের নির্যাতন সইতে না হয়, একটি মেয়েকেও যেন মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর স্বনির্ভরতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে না হয়।
হয়তো আমাদের ভালেবাসাও যদি এই দিনটিকে ঘিরে, নিজেদের পারিবারিক বলয়ের বৃত্তে আরও একটু সুদৃঢ় হয়, তবেই না, আমি এবং তুমি, সেও অমর হয়ে থাকবে…আমাদের ভালোবাসার নিজস্বতায়…!