ফিচার
বরগুনার প্রাচীন স্থাপত্য বিবিচিনি শাহী মসজিদ
মো. আবু সাইদ খোকন , বরগুনা :
শেষ বিকেলের সোনালী আলো জড়িয়ে নতুন কংক্রিটের পথ পেড়িয়ে মসজিদের ঠিক পাদদেশে দাঁড়ালাম। মেঘলা আাকাশ , কালো কাট কয়লার আবরনে ঢাকা মেঘ আকাশে উঁকিঝুঁকি মারছে এরই মধ্যে সূর্যের সোনালী আলো মেঘের ফাঁকফোকড় দিয়ে মাঝে মধ্যে বেড়িয়ে এসে আলোর দ্রুতি ছড়াচ্ছে । পরিবেশটা চমৎকার, রোমাঞ্চকর উত্তেজনা ভরা মন নিয়ে এগিয়ে চলছি। এ চলা আজকের নয়, আমার সফর সঙ্গীদের দীর্ঘদিনের লালিত ম্বপ্ন আাজ পুরন হতে চলছে। এরই মধ্যে সাথে আরো দু’জন স্রেফ পর্যটক যুক্তহয়েছে। দেশের দক্ষিনাঞ্চলের বঙ্গোপসাগরের উপকুলে অবস্থিত বরগুনা জেলা। অসংখ্য খাল-বিল, নদ-নদী আর সবুজ বন রনানীর সৌন্দার্যের পসরা নিয়ে সাজানো ঐতিহ্যবাহী এ জনপথ। এখানকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সর্ম্পকে দেশের কম মানুষের জানা । তাই বরগুনার একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান নিয়ে আজকের আয়োজন । এটি কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন স্পট ।
মসজিদের অবস্থান ঃ বরগুনার বেতাগী উপজেলা সদর থেকে আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে উত্তর দিকে ১০ কিলোমিটার পথ অগ্রসর হলেই বিবিচিনি গ্রাম। আলো জ্বলছে সদা। দিগন্ত জোড়া সবুজের বর্নিল আতিথেয়তায় উদ্ভাসিত ভিন্ন এক ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যে উঁচু টিলার উপর মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে মোঘল স্থাপত্য কর্ম এই ঐতিহাসিক মসজিদ। এ এক হৃদয় ছোঁয়া পরিবেশ যা ভুলবার নয়, নয় প্রকাশের। চক্ষু কর্নের দ্রুবুপদী অন্বেষনে শুধু বলা যায় সুন্দর। মনোহর অনুপম। দেশের অনেক দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে বিবিচিনি মসজিদ একটি। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এই মসজিদকে গোটা দক্ষিন বাংলার ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই উজ্জ্বল নির্দশনটি টিকে থাকলেও কালের বিবর্তনে আজ এর ঐতিহ্য অনেকটা হারিয়ে গেছে। তবু এর অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ পুরানো ঐতিহ্য ও শৌর্য বীর্যের কথা স্মরন করিয়ে দেয়। পূর্বে মসজিদটির অনেক জৌলুস ছিলো এবং মসজিদ নিয়ে প্রাচীন নানা কিংবদন্তী এখানে প্রচলিত রয়েছে। মসজিদ ঘিরে রয়েছে আরও অনেক অলৌকিক ঘটনার কাহিনী, নানা ইতিহাস। জানাযায়, এই মসজিদের নির্মাতা সাধক নেয়ামত শাহের কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সাথে বিবিচিনি গ্রামেরও নামকরন করা হয়েছে। চিনিবিবি থেকেই বিবিচিনির সৃষ্টি হয়।
ঐতিহ্য ও গুরুত্ব ঃ মসজিদটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক বিষ্ময়কর স্থান হিসাবে গুরুত্ব বহন করে আসছে। এর সাথে জড়িত রয়েছে বাংলার অন্যতম মোঘল স্থাপত্যশিল্প এবং এলাকার পুরনো দিনের অতীত স্মৃতি ও ঐতিহ্য। ঐতিহাসিক কীর্তি হিসেবেও দক্ষিনাঞ্চল তথা সমগ্র দেশের নীরব স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্রাট শাহজাহানের সময় সূদুর পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে শাহ নেয়ামতউল্লাহ দিল্লীতে আসেন। এ সময় দিল্লীর সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র বঙ্গ দেশের সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহন করেন এবং কতিপয় শিষ্যসহ বজরায় চড়ে তিনি ইসলাম প্রচার ও ইবাদতের জন্য ভাটির মুলুকে প্রবেশ করেন। শাহ নেয়ামতউল্লাহ বজরায় চড়ে দিল্লী থেকে রওনা হয়ে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে এসে পৌঁছলে বিবিচিনিতে শাহজাদা বাংলার সুবেদার মোহাম্মদ শাহসুজার অনুরোধে একই গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিবিচিনি গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম নেয়ামতি। নেয়ামতিও নেয়ামত শাহের নামানুসারে নামকরন করা হয় বলে জানাযায়। এক সময় এ অঞ্চল ছিল মগ ফিরিঙ্গিদের তুমুল হামলার আড্ডা ভুমি। হামলার প্রতিরোধ ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে মসজিদটি অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। মগ ফিরিঙ্গীদের দমনের জন্য শাহসুজা ঝালকাঠির সুজাবাদে এক সেনানিবাস গড়ে তোলেন, উহা সুজাবাদ কেল্লা নামে পরিচিত।
মসজিদটির আকৃতি : সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদটির দৈর্ঘ ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া বিশিষ্ট। দক্ষিনে এবং উত্তর দিকে তিন তিনটি দরজা রয়েছে। এগুলো খিলানের সাহায্যে নির্মিত হয়। মসজিদের ইটগুলো বর্তমানের আধুনিক যুগের ইটের মত নয়। ইহা মোঘল আমলের তৈরী ইটের মাপের ন্যায়। ইহার দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং চওড়া ২ ইঞ্চি। সমতল ভূমি হতে মসজিদ নির্মিত স্থানটি আনুমানিক কমপক্ষে ৩০ ফুট সুউচ্চ টিলার উপর অবস্থিত। তার উপরেও প্রায় ২৫ ফুট মসজিদ গৃহ।
নির্মাতা ও নির্মানকাল: ঐতিহাসিক বিবিচিনি মসজিদের সাথে যে নামটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত আছে তিনি হলেন মহান আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পীঠ স্থান তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপে এই খ্যাতনামা সাধক পুরুষ ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে পর্দাপন করেন। পরবর্তী এ অঞ্চলে আগমনের পর একই খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় শাহনেয়ামতুল্লাহ এই স্থাপত্য কর্ম বিবিচিনি মসজিদ নির্মান করেন। সমুদ্র সৈকতের দক্ষিন বাংলায় ইসলাম প্রচারের প্রদীপ্ত ভাস্কর ছিলেন শাহ নেয়ামতুল্লাহ। তিনি ছিলেন এক অসাধারন ব্যক্তিত্ব। যার দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। একজন মানুষ যার জন্মই ছিলো অসাধারন সৌভাগ্যের প্রতীক। যার ব্যক্তি মর্যাদা ও অলৌকিকতার গুনে বহু হিন্দু, বৌদ্ধ দীক্ষিত হয় ইসলাম ধর্মে। এ ছাড়াও জনবহুল বৃহত্তর বরিশালের হাজার হাজার মুসলিম জনগোষ্ঠী শাহ নেয়ামতুল্লাহর শিষ্যত্ব গ্রহন করে। তিনি নামজাদা কলুষমুক্ত পীর বলে পরিচিত ছিলেন। এই প্রিয় ব্যক্তিত্বের অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। জানা যায়, তখনকার সময় বিষখালী নদীর পানি ছিলো লবনাক্ত। পানের উপযোগী ছিলো না। সুপেয় পানির অভাবে জনগন বহুকষ্ট পেত। নেয়ামত শাহ মানুষের এই কষ্টের কথা অনুভব করে তার সাধকতার আশ্চর্য তসবিহটি বিষখালী নদীতে ধুয়ে দিলে পনি হয়ে যায় সুপেয়। আজও সেই পানি একই অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া সে যুগে সুন্দরবন সংলগ্ন বিষখালী নদীতে অসংখ্য কুমির ছিল। তার অলৌকিক প্রচেস্টায় বিবিচিনি সংলগ্ন বিষখালী নদী এলাকায় কোন কুমীর আসতনা। এ কাহিনী এখনো এ এলাকায় প্রচলিত রয়েছে।
অলৌকিক ঘটনা : এই দর্শনীয় শোভা বধর্নকারী মসজিদটি ঘিরে রয়েছে নানাধরনের ঘটনা যা মানুষের মনে কৌতুহল সৃষ্টি করে। শোনা যায়, পূর্বেকার সময় স্বপ্নে প্রাপ্ত দূরবর্তী অনেক লোকজন এই মসজিদ থেকে গুপ্তধন নিয়ে যেত। প্রতিদিন এখানে অগনিত নারী পুরুষ এসে নামাজ আদায় করে তাদের নেক মকসুদ পূর্নতা লাভের উদ্দেশ্যে। এছাড়া টাকা পয়সা ও অন্যান্য মানতের মালামাল রেখে যেত মসজিদ প্রান্তে। প্রতি সপ্তাহে অসংখ্য মানুষ এসে সারাক্ষন ইবাদত বন্দেগী করে কাটায়। যে যে ধরনের প্রত্যাশা নিয়ে এখানে আসে তার অধিকাংশ আশাই পূর্ন হয় বলে অসংখ্য মানুষের কাছে শোনা যায়।
সন্তান লাভ : আছিয়া বেগম। বিবাহের পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও অনেক চেষ্টার পরও সম্ভব হয়নি তার একটি সন্তানের মুখ দেখা। অবশেষে নতুন আশায় সে আবারো বুক বাধেঁ। স্রষ্টাকে স্মরন করে মানত করে মসজিদের উদ্দেশ্যে। বলা যায়, বাস্তবেই তার সে আশা পূর্ন হয়। ১ টি কন্যা সন্তান লাভ করে। মসজিদের পার্শ্ববর্তী গ্রামেই আছিয়ার বসবাস। শুধু আছিয়া বেগমই নয়, ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে ও এমনকি বিভিন্ন পরীক্ষা, চাকুরী লাভ এসব নিয়েও মানত করে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও আগত অগনিত মানুষ তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এখানে আসেন। মসজিদের কাছেই রয়েছে ছোট বড় ৩ টি পুরানো দীঘি। মোঘল আমলের এ দিঘী থেকে মানুষ যা চাইতো তা পাওয়া যেতো বলে শোনা যায়। মসজিদের নিকটবর্তী বড় দিঘীটি ইছাবিবির দিঘী নামে পরিচিত। তবে বর্তমানে এসব দিঘীর অস্তিত্ব বিপন্ন প্রায়।
ব্রিটেনে মসজিদের নিদর্শণ : প্রসাদের মতো অপরুপ কারুকাজ মন্ডিত মসজিদটির রয়েছে নানা ইতিহাস। জানা গেছে, মোঘল স্থাপত্যের গৌরব, মর্যাদার ও ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসেবে দেশেই নয় বাংলাদেশের বাহিরেও এমনকি ইতিহাস খ্যাত বৃটেন যাদুঘরেও এ স্থাপত্যটি সম্পর্কে নির্দশন পাওয়া গেছে। যা পাঁচশত বছরের পূর্বের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ব্যতিক্রমী কবর : মসজিদের পাশেই রয়েছে ৩টি ব্যতিক্রম ধর্মী কবর, কবরগুলো সাধারন কবরের ন্যায় হলেও লম্বায় ১৪-১৫ হাত। মসজিদের পশ্চিম ও উত্তর পাশে অবস্থিত কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সাধক নেয়ামতউল্লাহ এবং সহোদর চিনিবিবি ও ইছাবিবি। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে নেয়ামত শাহের ইহকাল ত্যাগের পর তাকে এ স্থানে সমাহিত করা হয়।
প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব : সাধক নেয়ামত শাহের নির্মিত বিবিচিনির ইতিহাস সমৃদ্ধ মসজিদটির ধ্বংষাবশেষ দীর্ঘ দিন সংস্কার বিহীন থাকার পর প্রায় ১২ বছর পূর্বে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ রক্ষনাবেক্ষনের জন্য সংস্কারের উদ্যেগ নেয়। অনেকপূর্বে এ কাজ সম্পন্ন হলেও তা যথেষ্ট নয়। জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে মসজিদের আরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও সংস্কারের জন্য প্রতœতত্ত্ব বিভাগ ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় অদ্যবধী এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি। মসজিদটির এখনো অনেক কাজ বাকী। নির্দশনটি দেখতে আসা-যাওয়ার উপযোগী রাস্তার অভাবে দর্শনার্থীদের ভোগান্তি হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি পান, অজু ও স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহারের ব্যবস্থা নেই। মসজিদটি রক্ষনাবেক্ষনের জন্য একজন কেযারটেকার থাকলেও নেই অন্য কোন দায়িত্বশীল লোক।
সর্বশেষ : মসজিদটি প্রয়োজনীয় রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে দিন দিন ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী কতিপয় লোক মসজিদের টিলার পাদদেশ কেটে জমি বৃদ্ধি করে চাষাবাদ করছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। বিবিচিনি শাহী মসজিদের উন্নয়নে সরকারের আরো নতুন পরিকল্পনা গ্রহন প্রয়োজন ও অন্যান্য সকলেরও সচেষ্ট এবং উদ্যেগী হওয়া দরকার। টিলার উপর ওঠার চেস্টা,অবশেষে উঠে পড়লাম, সুন্দর মনোরম পরিবেশ সত্যি আকুল করে দেয়। উপরে উঠে মনেহল নদী বেস্টিত এই জনপদের ছোট-খাট একটি পাহাড়ে উঠেছ্,ি এমন পরিবেশ থেকে মন চায়না চলে যাই কিন্তু সন্ধ্যাঘনিয়ে আসছে বাড়ি ফেরার তারা। এগিয়ে যাচ্ছি সাধনার তীর্থ স্থান পিছে ফেলে গুডবাই জানিয়ে ভাবছিলাম আবার আসব তখন তোমায় দেখব নতুন রুপে অন্য কোন ভাবে।