একই পরিবারের নি*হ*ত ছয়জনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম
ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় মর্মান্তি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত রেইনবো কুরিয়ার কোম্পানির সিলেটের বিভাগীয় ম্যানেজার হাসিবুর রহমান প্রিন্সের দক্ষিণ সাইথপু গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
পাশাপাশি প্রিন্সের শ্যালিকা নববধূ নিপা আক্তার ও ভায়রা বিমান বাহিনীর সৈনিক আল ইমরানের সাংগর গ্রামের বাড়িতেও স্বজনহারাদের কান্না থামছে না। নিপার হাত থেকে মেহেদীর রং-ও মুছে যায়নি। তাদের ইচ্ছে ছিল কুয়াকাটা হানিমুনে যাওয়ার। সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না।
দুই পরিবারের শোকে মূর্হমান পুরো উপজেলা। নিহতদের পরিবারের কান্না দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেনি প্রতিবেশীরাও। হাজারো মানুষ অংশ নেয় তাদের জানাজায়। এ ঘটনায় নিহত প্রিন্সের ছোট ভাই হাদিউর রহমান বাদী হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঝালকাঠি থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় ট্রাকের চালক আল আমিন হাওলাদার ও চালকের সহকারী নাজমুল শেখকে আসামি করা হয়।
জানা যায়, হাসিবুর রহমান প্রিন্স সিলেট থেকে সম্প্রতি বদলী হয়ে বরিশালের বিভাগীয় ম্যানেজার হিসেবে রেইনবো কুরিয়ার কোম্পানিতে যোগদান করবেন বলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে আসেন। বরিশালে বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য স্ত্রী নাহিদা সুলতানা, মেয়ে তাকিয়া ও ছেলে তাহমিদের সঙ্গে নববিবাহিত শ্যালিকা নিপা আক্তার ও ভায়রা আল ইমরানকে নিয়ে বুধবার দুপুরে একটি প্রাইভেটকারে রওয়ানা হন বরিশালের উদ্দেশ্যে।
ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় এসে টোল দেওয়ার সময় পেছন থেকে একটি সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক দ্রুতগতিতে এসে তাদের প্রাইভেটকারটিকে চাপা দেয়। এতে দুমড়ে মুচড়ে প্রাইভেটকারটি পাশের খাদে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ছয়জনসহ চালক নিহত হয়।
রাতে সুরতহাল শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ। লাশবাহী গাড়ি বাড়ি পৌঁছলে দুই পরিবারের স্বজনদের কান্নায় ভাড়ি হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস। প্রিন্স এলাকায় দানবির হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। এলাকার অসংখ্য মানুষকে সিলেটের বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। শোকের মধ্যেও তাঁর ভালো কাজের প্রশংসা করছিলেন এলাকাবাসী।
এদিকে নববধূ নিপা আক্তার ও তাঁর স্বামী বিমান বাহিনীর সৈনিক আল ইমরানের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুতে কক্সবাজার হানিমুনে যাওয়া হলো না তাদের। ইচ্ছে ছিল ঈদের পরে হানিমুনে যাবে এই নবদম্পত্তি।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় রাজাপুর উপজেলার দক্ষিণ সাউথপুর দাখিল মাদরাসা চত্বরে জানাজা নামাজ সম্পন্ন হয় নিহতদের। জানায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ অংশ নেন। পরে নিহতদের নিজ বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা উত্তর সাউতপুর ও সাংগর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়কের পাশে পুকুর ও ডেবাগুলোকে ভরাট করেছে জেলা প্রশাসন। মোবাইল কোর্টের সংখ্যাও বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজাপুরের সাউথপুর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রিন্সের মা রাজিয়া বেগম, ভাই হাদিউর রহমান তাকবিরসহ পরিবারের সদস্যরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। বাসার সামনে বসেই বিলাপ করছেন মা রাজিয়া বেগম।
কখনো লাফিয়ে উঠে বাবা বাবা বলে চিৎকার করছেন, আবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। তাকে শান্তনা দিচ্ছেন প্রতিবেশীরা। সবার চোখ থেকেই পানি ঝড়ছে। এদিকে বাড়ির সামনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সেখানে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা কবর তৈরি করছেন। কবরের পাশে গিয়ে ছোটভাই হাদিউর রহমান কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিকেলে দাফন করা হয় তাদের।
নিহত প্রিন্সের মা রাজিয়া বেগম বলেন, আমার ছেলে প্রিন্স অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিল। সে কখনো কোন অন্যায় করেনি। তবুও কেন এমন দুর্ঘটনায় তাকে মরতে হবে। আমার একমাত্র উপার্জক্ষম ছেলে চলে যাওয়ায় আমরা সবাই ভেঙে পরেছি।
নিহতের ভাই হাদিউর রহমান বলেন, আমার ভাইসহ ৬জনকে হত্যাকারী ট্রাক চালককে আটক করেছে পুলিশ। আমরা চাই তাঁর সর্বোচ্চ সাজা হোক।
স্থানীয় বাসিন্দা ডেজলিং তালুকদার বলেন, গাবখান সেতুর টোল প্লাজা সেতুর খুব কাছেই করা হয়েছে। এটি একটু দূরে সরিয়ে নিলে এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতো না। আমাদের দাবি গাবখান সেতুর টোল প্লাজা একটু সরিয়ে দূরে করার জন্য। নিহতরা আমার স্বজন। এমন মৃত্যু রাজাপুরে কখনো হয়নি।
নিহতের স্বজন তরিকুল ইসলাম তারেক বলেন, পরিবারের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন প্রিন্স ও তাঁর স্ত্রী সন্তানরা। প্রিন্স এলাকায় অনেক দান অনুদান দিয়েছেন।
স্থানীয় অনেক বেকার যুবককে সিলেটে চাকরি দিয়েছেন। প্রিন্সের কথা সবার হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। বাবা মায়ের অত্যন্ত প্রিয় সন্তান ছিল সে। তাঁর মৃত্যুতে মা রাজিয়া বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
ঝালকাঠি পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রিন্সের ভাই বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। ইতোমধ্যে আমরা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করেছি। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যাতে হয়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্রাকের চালকের হালকা যান চালানোর লাইসেন্স আছে, ভারি যান চালানোর লাইসেন্স নেই।
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম বলেন, আমরা সড়কের পাশে পুকুর ও ডোবা ভরাট করেছি, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলেও পানিতে পড়ে কারো মৃত্যু না হয়। যানবাহনে নিয়মিত মোবাইলকোর্ট করা হচ্ছে।
যেসব বাহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। পাঁচ দিনের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, বুধবার দুপুরে বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের ঝালকাঠির গাবখান সেতু টোল প্লাজায় এলাকায় টোল দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকা প্রাইভেটকার সহ তিনটি অটোরিকশাকে পেছন থেকে সিমেন্ট বোঝাই একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাপা দেয়।
এ ঘটনায় একই পরিবারের চারজনসহ ১২ জন ঘটনাস্থলে নিহত হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দু’জন নিহত হন। এ ঘটনায় ট্রাকের চালক ও চালকের সহকারীকে আটক করেছে পুলিশ। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।
ঝালকাঠিতে সড়ক দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেন আমির হোসেন আমু
ঝালকাঠির গাবখান টোলপ্লাজা এলাকায় সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে আমির হোসেন ঢাকা থেকে সড়ক পথে ঝালকাঠি এসে সরাসরি গাবখান টোলপ্লাজা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার মোহাম্মদ শাহ আলমসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করে আহতদের খোঁজখবর নেন আমির হোসেন আমু।
দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আমির হোসেন আমু বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।
নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হয়েছে। এ ধরণের দুর্ঘটনা যাতে বারবার না ঘটে এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এইচকেআর