ঢাকা সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫

Motobad news

বাউফলে উপজেলা চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে আহত করার ছবি ভাইরাল

বাউফলে উপজেলা চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে আহত করার ছবি ভাইরাল
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উদযাপন উপলক্ষে গত শুক্রবার পটুয়াখালীর বাউফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওই সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদার দলীয় কার্যালয়ে যাওয়ার পথে স্থানীয় সংসদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ স ম ফিরোজের উপস্থিতিতে উপজেলা পরিষদের সামনে তাঁর ক্যাডার বাহিনী আবদুল মোতালেবকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর জখম করে।

আবদুল মোতালেবকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করার সেই ছবি গত দুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। আর ওই ছবি দেখে দলীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ হতভম্ব হয়ে যান।

চিকিৎসকের ভাষ্য অনুযায়ী, এতে আবদুল মোতালেবের ডান হাতের তৃতীয় আঙুল কেটে চামড়ার সঙ্গে ঝুলে থাকে। ডান পা ভেঙে যায়।এছাড়াও  তাঁর বুকের ডান পাশে ও ডান হাতের কনুইয়ের ওপরের অংশে জখম রয়েছে। দেয় ও মাথায় আঘাত লেগেছে। বর্তমানে তিনি রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

এ বিষয়ে বাউফল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়াউল হক বলেন,‘মোতালেব ভাইকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করার ছবি থেকে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে।‘ তিনি আরও বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত মানুষরুপী পশুদের এখনও গ্রেপ্তার করতে না পারাটা খুবই উদ্বেকজনক।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন ফরাজি বলেন,‘শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা। যিনি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের তিনবারের সাধারণ সম্পাদক। 

তিন বারের ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব। তাঁর ওপর স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির উপস্থিতিতে এমন বর্বরোচিত হামলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি দেখে আমি হতভম্ব হয়ে যাই,অনেক কেদেঁছি। এভাবে আবদুল মোতালেবকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করতে পারে তা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না।

বাউফল প্রৌঢ় নাগরিক কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবদুস ছালাম বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকাটা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় না, থাকতেই পারে। এ কারণে এভাবে একজন সাধারণ সম্পাদকের ওপর হামলা খুবই দুঃখজনক।’

সংঘর্ষের সময়কার ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুনের সামনেই ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা হাতে মহড়া দিচ্ছেন তিনজন এবং ভিডিওতে দেখা যায় সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ যে গাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁর পাশ দিয়ে ধারালো অস্ত্র ও লাটিসোঁটা নিয়ে কয়েকজন উপজেলা চেয়ারম্যানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। 

তাঁদের একজন ছাত্রলীগের কর্মী সজীব দাসের (২৭) হাতে লাঠি, লাল গেঞ্জি পরা কালাইয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য মোহাম্মদ শফি হাওলাদারের (৪৮) হাতে ধারালো অস্ত্র ও সাদা পাঞ্জাবি পরা চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এনামুল হক ওরফে আলকাচ মোল্লার (৪৭) হাতে লাঠি। তিনজনের বাড়িই উপজেলার কালাইয়া গ্রামে। তাঁদের মধ্যে এনামুল হক সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজের ভাতিজা।

তাঁরাই আবদুল মোতালেবকে ধারালো অস্ত্র ও লাটি দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করে। ছবিতে দেখা যায় আবদুল মোতালেব সড়কের ওপর শুয়ে পড়েছেন। এরপরেও শফি হাওলাদার, সজীব দাসসহ কয়েকজন কোপাচ্ছেন ও পিটাচ্ছেন।

কে এই শফি হাওলাদার?

শফি হাওলাদার (৪৯)। দশমিনা উপজেলার বহরমপুর ইউনিয়নের বগুরা গ্রামের আসমত আলী হাওলাদারের ছেলে। এলাকাবাসির ভাষ্যমতে, ছোট বেলা থেকেই উচ্ছৃঙ্খল স্বভাবের হওয়ায় শিক্ষায় প্রাথমিকের গÐি পার হতে পারেননি। ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নিজ এলাকায় ছিলেন। তখন এলাকায় ছিনতাইকারী ও ভাড়াটে বখাটে হিসেবে পরিচিত ছিল তাঁর। আওয়ামী লীগ জোট সরকার ক্ষমতায় এলে একপর্যায়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন শফি হাওলাদার। 

বাউফল উপজেলার কালাইয়া এলাকায় এসে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজের ভাতিজা কালাইয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম ফয়সাল আহম্মেদ ওরফে মনির মোল্লার ছত্রছায়ায় যুবলীগের রাজনীতি শুরু করেন।

২০০২ সালে ফের বিএনপিতে যোগ দেন শফি হাওলাদার। উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক গাজী মো. গিয়াস উদ্দিনের ছত্রছায়ায় রাজনীতি শুরু করেন। তখনও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে তত্ত্বাধায়ক সরকারের সময় পালিয়ে ছিলেন শফি হাওলাদার। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ফের মনির মোল্লার হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন বিরোধী শিবিরকে ধাবিয়ে রাখার শর্তে। এমনটাই দলীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজের রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে তাঁদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। এরপরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালানো বাদ দিয়ে মোল্লা পরিবারের বিভিন্ন ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব পান।

শফি হাওলাদার কালাইয়া বাজারের সুপাড়ির হাটের সরকারি জায়গা দখল করে দোকানঘর নির্মাণ করে ভাড়া নিচ্ছেন। কালাইয়া-বড়ডালিমা সেতুর পশ্চিম পাশে মো. শাহ আলম হাওলাদার নামে এক ব্যবসায়ীর জমি দখল করে পাকা ভবন  নির্মাণ করে বসবাস করছেন।

শফির হাত থেকে সাংবাদিক,চাকুরিজীবি ও জনপ্রতিনিধিও রেহাই পাননি
২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাঁর হামলার শিকার হয়ে আহত হয়েছিলেন দৈনিক ইনকিলাবের বাউফল প্রতিনিধি মো. নূরুল ইসলাম সিদ্দিকী ওরফে মাসুম (৪৭)। শফি হাওলাদার প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে মামলা করার সাহস পাননি নূরুল ইসলাম।
শফি হাওলাদার ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর মো. গালিব নামে ওষুধ কোম্পানির এক বিক্রয় প্রতিনিধিকে কালাইয়া বাজারে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গুরুতর জখম করার পর রামদা নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দিয়েছিলেন। গালিবের ডান হাত দিয়ে স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন না। ওই মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে। যা বিচারাধীন। 

এছাড়াও ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি বগা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাহামুদ হাসানকে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে শফি হাওলাদার।  তখন স্থানীয় সাংসদ আ স ম ফিরোজ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। এ ঘটনায়ও মামলা রয়েছে।

তাঁর হামলা ও মারধরের শিকার হয়ে প্রায় চার বছর ধরে এলাকা ছাড়া কালাইয়া বন্দরের এক হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। সর্বশেষ ২২ মার্চ বুধবার উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রেজাউল কামাল ওরফে পল্টুর ওপর হামলা ও বসতঘরে ভাঙচুরের নেতৃত্বেও ছিলেন শফি হাওলাদার। এ ঘটনায় বাউফল থানায় মামলা হয়েছে।


এসব বিষয়ে নিয়ে শফি হাওলাদার বলেন,‘সব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।’ তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন এবং ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি অ্যাডিট করা বলে তিনি দাবি করেন।

এ বিষয়ে বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন বলেন,‘কয়েক দফায় গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান করা হয়েছে। শফি হাওলাদার পলাতক আছেন।তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
 


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন