চার বছরেও প্রকাশ হয়নি কীর্তনখোলা নদী দখলদারদের তালিকা
বরিশাল নগরী এবং সদর উপজেলার কোলঘেঁষে বয়ে চলেছে কীর্তনখোলা নদী। ১৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৪৯৭ মিটার প্রস্থের এই নদী ক্রমশই দখল হয়ে যাচ্ছে। দুই তীর দখল করে গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা। আর তাই দখল দূষণে কীর্তনখোলা নদী তার চিরচেনা রূপ হারাতে বসেছে।
অথচ ঐতিহ্যবাহী কীর্তনখোলা নদীর দখল-দূষণ রোধে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না বলে দাবি নদী রক্ষায় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া সংগঠকদের। এমনকি ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসন ও নদী বন্দর কর্তৃপক্ষের করা চার সহস্রাধিক অবৈধ দখলদারের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি গত চার বছরেও।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, ‘প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং অসহযোগিতার কারণেই কীর্তনখোলা নদীর দখলদারদের সংখ্যা দীর্ঘ হচ্ছে। আর এজন্যই ঐতিহ্যবাহী কীর্তনখোলা নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে বলে মনে করেন তারা।
যদিও নদী রক্ষায় অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করার এখতিয়ার জেলা প্রশাসনের বলে দাবি করেছেন বিআইডিব্লিউটিএ’র বরিশাল নৌ বন্দরের যুগ্ম পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক। অন্যদিকে জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলছেন, ২০১৯ সালে অবৈধ দখলদারদের তালিকা সম্পর্কে তিনি অবগত নন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বেলা) বরিশাল জেলা কমিটির তথ্য মতে, নদীমাত্রিক বরিশাল অঞ্চলে মূল নদী আছে ২৫টি। এছাড়া শাখা নদীসহ মোট নদীর সংখ্যা প্রায় ৩৫টি। এসব নদীর মধ্যে শুধু কীর্তনখোলা নদীর দুই তীরে গত প্রায় ৪২ বছরে দখল করেছেন পাঁচ হাজারের বেশি।
সংগঠনটির জেলা সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, ‘নদী রক্ষা কমিশনের আহ্বানে ২০১৯ সালে নদীর দখলদারদের তালিকা করে জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ। তখন খসড়া তালিকায় ৪ হাজার ২১৯ জন অবৈধ দখলদারদের নাম উঠে আসে। যার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারাও রয়েছেন। কিন্তু খসড়া তালিকা করার চার বছর কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত সেই তালিকা রহস্যজনক কারণে প্রকাশ করা হয়নি।
রফিকুল আলম বলেছেন, ‘নদীর দখল-দূষণ রোধে আমাদের মাসব্যাপী সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ নিয়ে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। তবে দখল-দূষণের বিরুদ্ধে প্রশাসন সোচ্চার না হওয়ায় কীর্তনখোলা নদীর চিরচেনা রূপ হারিয়ে যাচ্ছে।
নদী বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘নদীর দুই তীরের যে অংশ শুস্ক মৌসুমে চর পড়ে এবং বর্ষা মৌসুমে ডুবে যায়, সেই অংশকে ফোরশোর বলা হয়। ফোরশোর এলাকায় কারোর অধিকার থাকে না। কেউ ওই জমি দখল করলে তিনি অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ‘কীর্তনখোলা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জেগে ওঠা রসুলপার চর, মোহাম্মদপুর চর, দপদপিয়ার চর, কর্ণকাঠী চর, খোন্নারের চর, চর বাড়িয়ার চর, ধানগবেষণা সড়ক এবং দপদপিয়া ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকা দখল করে আছে প্রভাবশালীরা।
এছাড়াও নগরীর পোর্টরোড থেকে দপদপিয়া পর্যন্ত নদীর দুই তীর দখল হয়ে আছে দীর্ঘ বছর ধরে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং দলীয় নেতাদের প্রভাবে দখল হওয়া নদীর তীরে ইট, বালু, পাথর বিক্রির খোলা, লঞ্চ এবং জাহাজ তৈরির ডকইয়ার্ড, কয়লা বিক্রির খোলা, বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হচ্ছে। এমনকি নদী দখল করে সিটি করপোরেশন নির্মাণ করেছে শহর রক্ষা বাঁধ। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের পরিত্যাক্ত এবং অকার্যকর নৌযান ফেলে দখল করা হয়েছে নদীর তীর।
বরিশাল জেলা প্রশাসন কার্যালয় ও নদীবন্দর সূত্রে জানা গেছে, ‘নগরীর উত্তর আমানতগঞ্জ খাল থেকে দক্ষিণে রূপাতলী সিএসডি গোডাউনের খালের দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫৭০ কিলোমিটার কীর্তনখোলা নদী বিআইডব্লিউটিএ’র অধীনে। বাকী অংশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং জেলা প্রশাসনের।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ‘জালিয়াত চক্র এবং প্রভাবশালীরা জাল দলিল তৈরি করে নদী দখল করেছে। নদীর মধ্যে গাইডওয়াল দিয়ে নিজেদের মালিক দাবি করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে। এমন চিত্র দেখা গেছে, নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধানগবেষণা রোডের পাকার মাথা এবং মেরিন একাডেমি সংলগ্নে। নদীর দেড় কিলোমিটারের বেশি এলাকা দখল করে গাইডওয়াল এবং বাঁশ-চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে বালু ভরাট করা হয়েছে।
নগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের রসুলপুর বস্তি এবং পার্শ্ববর্তী মোহাম্মদপুর বস্তির নামে দখল হয়ে গেছে কীর্তনখোলা নদী। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু অংশে বাঁশ ও টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে বিক্রি করা হচ্ছে নদীর চর। স্থানীয়দের অভিযোগ বিএনপির এক নেতা জাল জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল বানিয়ে বিক্রি করছেন চরের জমি। এমনকি জমি দখল করতে নির্মাণ করা হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বরিশাল জেলা প্রশাসন ও নদী বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ‘সবশেষ গত ২০২১ সালে উচ্চ আদালত সিএস মৌজা ম্যাপ ধরে নদীর সীমানা নির্ধারণ করার আদেশ দিয়েছে। তবে কীর্তনখোলা নদীর সীমানা নির্ধারণে তেমন কোন কার্যক্রম দেখা মিলছে না।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ‘নদী রক্ষায় আমরা আন্দোলন করে আসছি। কদিন আগেও বিশ্ব নদী রক্ষা দিবসের দিনে কীর্তনখোলা নদীর দখল-দূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসন এবং নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা করেছিল। এখন পর্যন্ত সেই তালিকাই প্রকাশ করা হয়নি। এ তালিকায় অনেক ক্ষমতাসীন ব্যক্তি আছেন। এ কারণে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ বরিশাল নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘নদীর তীর রক্ষায় উচ্ছেদ অভিযানে অনেক জটিলতা রয়েছে। এ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গে আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে কোন সাড়া পাইনি। যে কারণে উচ্ছেদ অভিযান করতে পারিনি।
বন্দরের যুগ্ম পরিচালক আরো বলেন, ‘অবৈধ দখলদারদের মধ্যে অনেক কাউন্সিলর, ক্ষমতাসীন দলের নেতাও রয়েছেন। এদের উচ্ছেদ করতে গেলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং মেয়রকে এই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলাম। তারা থাকলে আমাদের জন্য নদী রক্ষার কাজটি আরও সুবিধা হবে।
বরিশাল জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৯ সালে কীর্তনখোলা নদীর দখলদারদের কোন তালিকা হয়েছে কী-না আমার জানা নেই। তবে নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশে আমরা নতুন করে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করছি। তালিকা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
আরজেএন