ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

Motobad news

রাস্তা নয়, লাশ নিতে হলো পুকুর দিয়ে

রাস্তা নয়, লাশ নিতে হলো পুকুর দিয়ে
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

হরিধনের বাড়ি থেকে বের হতে অন্যের রাস্তা ব্যবহার করতে হয়। প্রতিবেশীর বাড়ির ওপর দিয়ে যাতায়াত হরিধনের পরিবারের। এ নিয়ে বড় কোনো অভিযোগ ছিল না প্রতিবেশীর। বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) মারা যান হরিধনের মা মনমোহিনী দাস (৯৫)। এ সময় হরিধনের পরিবারের পাশে থাকার কথা প্রতিবেশীদের। কিন্তু দেখা গেল ভিন্ন রূপ। বৃদ্ধার শবযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবেশীদের বাড়ির পথ। অজুহাত হিসেবে তারা সামনে আনেন 'ব্রত নষ্ট ও বাড়ির বধূ নিঃসন্তান' হওয়ার কুসংস্কার।

মায়ের লাশ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবেশী এক পরিবার থেকে জানানো হয়, বাড়ির ওপর দিয়ে লাশ নিলে ‘ব্রত’ পালনে সমস্যার সৃষ্টি হবে। আরেক পরিবার জানায়, কবিরাজ জানিয়েছে- বাড়ির ওপর দিয়ে লাশ গেলে বিবাহিতা নারী নিঃসন্তান থেকে যাবে।

প্রতিবেশীদের বাধায় বৃদ্ধা মনমোহিনীর লাশের যাত্রা হয় পুকুর দিয়ে। কয়েকজন মিলে কাঁধে করে পুকুরের পানি মাড়িয়ে লাশ এনে রাখেন পাড়ে। এরপর সেখানে রাখা বাঁশের তৈরি ‘খাঁটিয়ায়’ করে তাঁর লাশ সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় শ্মশানে।

এমন ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার তালশহর পশ্চিম ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া গ্রামে। পুকুর দিয়ে লাশ কাঁধে করে নিয়ে যাওয়ার ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। পরে এ বিষয় নিয়ে স্থানীয়ভাবে সভা হয়।

ব্রাহ্মণ-পুরোহিত কল্যাণ সংঘ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সভাপতি হরি শংকর চক্রবর্তী ঘটনাটি জানার পরই আফাসোস শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘এটা কুসংস্কার। বাড়ির ওপর দিয়ে লাশ নিয়ে গেলে কারো ব্রতে সমস্যা হবে কিংবা পূজা পালনে সমস্যা হবে বলে আমার জানা নেই। কাজটি মোটেও ভালো হয়নি। শাস্ত্রে বলা আছে, লাশের বিষয়টি সব কিছুর ঊর্ধ্বে।’

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা হরিধন দাসের চলাচলের জন্য পার্শ্ববর্তী একাধিক পরিবারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর মধ্যে হারাধন দাসের বাড়ির ওপর দিয়েই তাদের পরিবারের চলাচল। যদিও ওই দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোরে হরিধনের মা মনমোহিনী মারা যান। এ অবস্থায় হারাধনের বাড়ির ওপর দিয়ে লাশ নেওয়ার জন্য হরিধনের পরিবারের কাছে যাওয়া হয়। এ সময় চলতি মাসে ব্রত পালনের অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকে বিকল্প অন্যপথ দিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়। হারাধানের ভাই পরিমলের কাছে গেলেও একই কথা বলা হয়। সঙ্গে কবিরাজের অজুহাত দিয়ে দাবি করে, বাড়ির ওপর দিয়ে অন্যের লাশ নিয়ে গেলে বাড়ির বধূ নিঃসন্তান থাকবে।

হরিধন দাসের ছেলে বিজয় দাস অভিযোগ করেন, 'হারাধন দাসের কাছে তার বাড়ির ওপর দিয়ে লাশ নেওয়ার জন্য অনুমতি আনতে তাদের বাড়িতে যান। কিন্তু তাদেরকে অনেক বুঝিয়েও অনুমতি নিতে না পেরে পুকুরের ওপর নিয়ে লাশ নেওয়া হয়।'

হারাধন দাস সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী কার্তিক মাসে ব্রত পালনের পাশাপাশি নিরামিষ খেতে হয়। যদি আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে কেউ মরদেহ নিয়ে যায়, তাহলে আমাদের হাঁড়িপাতিলসহ সব কিছু ফেলে দিয়ে নতুন করে কিনতে হবে। যে কারণে লাশ নিতে না করেছি।’

তালশহর পশ্চিম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার (সদস্য) নিয়াজ কাজী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘হারাধনের পরিবার হরিধনের বাড়ির ওপর দিয়ে যাতায়াত করত। একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে ঘটনাটি ঘটে। আমরা মীমাংসা করে দিয়েছি। এখন থেকে আর সমস্যা হবে না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘লাশ নিয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি আমরা জানতে পারি। পরে আমরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত অফিসে সভা করেছি। থানা পুলিশসহ এলাকার গণ্যমান্যদের নিয়ে হওয়া সভায় বিষয়টির মীমাংসা হয়।’

তালশহর পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু সামা বলেন, ‘ভবিষ্যতে যেন আর এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে বিষয়টি সভায় নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন থেকে চলাচলসহ সব ধরনের কাজই হরিধনের বাড়ির ওপর দিয়ে করা যাবে।’ লাশ নিয়ে যাওয়ার পর  ঘটনাটি জানতে পারেন বলে এ জনপ্রতিনিধিও উল্লেখ করেন।

আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আজাদ রহমান বলেন, "ঘটনাটি তাৎক্ষণিক ঘটে গেছে। খবর পেয়ে সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ বিষয়টি নিয়ে সভা করেন। ওই সভায় জানানো হয়, পরবর্তী সময়ে এ ধরনের কোনো সমস্যা হবে না। প্রয়াতের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানেও ‘অভিযুক্তরা’ সহযোগিতা করবে।"

 


এমবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন