'সিডরের ক্ষত বয়ে চলেছি ১৪ বছর, স্বামী মৃত্যুর স্বীকৃতি চাই'


বরগুনার পাথরঘাটায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে স্বামীহারা অনেক নারী এখনাে পাননি তাঁদের 'বিধবা' স্বীকৃতি। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে মৃতদের পাওয়া যায়নি- এমন ৪৬ জনের পরিবার এখনো সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে আসেনি। সন্তান নিয়ে কষ্টে-সৃষ্টে দিন কাটছে সিডরে 'বিধবা' হওয়া এসব নারীর। মাছ ধরতে যাওয়া ওই সব জেলে বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন- তা নিয়ে দোলাচলে থাকায় সরকারি সহযোগিত থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁদের স্ত্রী ও শিশুসন্তানরা। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর উপকূলজুড়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় 'সিডর' বয়ে গেলে পাথরঘাটা উপজেলায় মারা যান ৩৪৯ জন।
তাঁদের সবার মরদেহ পাওয়া যায় বলে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে একাধিক ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে তালিকা করা হয়। তাঁদেরকে সরকার সাধ্যমতো সহায়তা প্রদান করে এবং পুনর্বাসনে বেসরকারি সংস্থাও সহায়তা করে। তবে এর বাইরে ৪৬ জন জেলে ঝড়ের আগে সাগরে মাছ ধরতে গেলে তাঁরা আর ফিরে আসতে পারেননি। তাঁদের মরদেহ হয়তো সামুদ্রিক প্রাণীর খাবারে পরিণত হয়েছে; সে জন্য তাঁরা মৃতদের তালিকাভুক্ত হননি। তাঁদের পরিচিতি দেওয়া হয় 'নিখোঁজ' বলে। ফলে সরকারি বা বেসরকারি সাহায্যও তাঁরা পাননি প্রত্যাশিত পর্যায়ে। গৃহহীন হয়েও পাননি মাথা গোঁজার মতো একটি রিলিফের ঘর। মেলেনি সরকারের বিধবা ভাতা। চাইতে গেলে তাঁদের স্বামী যে মারা গেছেন তার প্রমাণ চাওয়া হয়। বাদুড়তলা গ্রামে বাড়ির উঠানে শিশুসন্তান হাসানকে হাঁটিহাঁটি পা পা করে হাঁটা শেখাতেন বাবা মো. জাকির হোসেন। সেই বাবা যে সাগরে মাছ ধরতে গেলেন, আর ফিরে আসেননি। সেই ছেলে এখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। মা মর্জিনা বেগম অপরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। বারবার আবেদন ও নিবেদন করেও বিধবা ভাতা পাওয়ার তালিকায় নাম উঠাতে পারেননি তিনি। কিন্তু ছেলেকে বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন।
মর্জিনার মতো এমন বঞ্চিত মা আছেন অনেক। তাঁরা সধবা নাকি বিধবা- তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব পাননি স্থানীয় চৌকিদার, মেম্বার ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে। তাঁদের স্বামীদের নাম ওঠেনি মৃত্যু নিবন্ধন তালিকায়। জানতে চাইলে মর্জিনা বেগম বলেন, 'বিধবা ভাতা পেতে হলে আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে? এখনো আমি ১০ টাকা দরের চালের কার্ড, বিধবা ভাতা পাইনি।' একই গ্রামে লাভলী বেগমের স্বামী ইসমাইল হোসেন নিখোঁজ তালিকায়।
স্বামী নিখোঁজ জাকির হোসেনের স্ত্রী মাসুরার। তিন সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে চলছে তাঁর দিন। পান না কোনো ভাতা। কাঁঠালতলী ইউনিয়নের বকুলতলা গ্রামে বাস করেন পুতুল রানী। স্বামী হারানোর পর তাঁর আশ্রয় হয় বাপের বাড়িতে। তাঁর স্বামী নির্মল মিস্ত্রি এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে সাগরে মাছ ধরতে যান। এর পর থেকে নিখোঁজ। 'গত ১৪ বছরের প্রতিটি দিন, মাস ও বছর কিভাবে পার করেছি তার বর্ণনা দিতে গেলে মহাভারত লেখা হয়ে যাবে'- দুঃখের সঙ্গে কথাগুলো বলেন পুতুল রানী। ছেলে প্রসেনজিত ওরফে নিমন্ত্রণ এ বছর দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। মেয়ে পূর্ণিমা এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। 'কত যে দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তা সৃষ্টিকর্তাই জানেন'- চোখের পানি ফেলে বলেন পুতুল রানী।
বরগুনা জেলা বারের সদস্য ও পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. জাবির হোসেন বলেন, 'রাষ্ট্র প্রত্যেক মানুষের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্ব পালন করবে। সুতরাং দুর্যোগে স্বামীহারা নারীদের স্বামীর মৃত্যুর স্বীকৃতি নিশ্চিত করতেও বাধ্য।' পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ বলেন, 'আমি এ উপজেলায় নবাগত। এমন কষ্টদায়ক ঘটনার খোঁজ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।' বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান টেলিফোনে বলেন, 'বিষয়টি দুঃখজনক। নিখোঁজ জেলেদের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আলাপ করে সুরাহা করার ব্যবস্থা করা হবে।'
এইচকেআর
