ঢাকা সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫

Motobad news

এবারও চাষিকে কাঁদাচ্ছে আলু

এবারও চাষিকে কাঁদাচ্ছে আলু
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

উত্তরের জনপদ ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পটুয়া এলাকার বর্গাচাষি ওবায়দুল হক। লাভের আশায় এবার ঋণ করে ও সঞ্চয় ভেঙে ছয় একর জমিতে আগাম আলু চাষ করেছেন। বর্গা খরচসহ চাষে লেগেছে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। হাড়ভাঙা পরিশ্রম তো আছেই। কিন্তু স্বপ্নের সেই ফসল বিক্রি করতে গিয়ে কষ্টে বুক ভারী হয়ে ওঠে ওবায়দুলের।

উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামও তিনি পাননি। প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেছেন মাত্র ৬ টাকায়। গত সোমবার রাতে ওবায়দুলের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভাঙা ভাঙা গলায় তিনি বলেন, 'চিন্তায় দু'চোখে ঘুম আসে না- কীভাবে এনজিওর ঋণের কিস্তি শোধ করব। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকেও ঋণ করেছি। চার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার কীভাবে চলবে।' তবুও দুঃখ ভুলে আবার ফসল বুনবেন তিনি।

ওবায়দুল বলেন, চাষবাস ছাড়া তো আর কিছু শিখিনি। বারবার কাঁদালেও কৃষি নিয়েই মাটি কামড়ে আছি।

ওবায়দুলের মতো অবস্থা জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার ভিকনি গ্রামের আলুচাষি অজি উল্যাহর। তার তিন বিঘা জমিতে ফলন হয়েছে ২১০ মণ। প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি পেয়েছেন ৫১ হাজার টাকা। একই অবস্থা মুন্সীগঞ্জ, লালমনিরহাট, যশোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার চাষিদের। কৃষকপর্যায়ে আলু ৬-৭ টাকা কেজি হলেও খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২০ টাকায়।

চাষিরা জানান, এক বিঘা জমিতে আগাম আলু উৎপাদন করতে সাধারণত ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা খরচ হয়। গড়ে এক বিঘা জমিতে ৭৫ মণ আলু উৎপাদন হয়। ওই হিসাবে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ টাকারও বেশি। অথচ এই শীত মৌসুমে অন্যান্য সবজির দাম বাড়তির দিকে হলেও তা আলুর ক্ষেত্রে খাটছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলুর এ উল্টোযাত্রার কারণ বিপুল উৎপাদন। বিপরীতে বাজারে চাহিদা কম থাকা এবং নগণ্য পরিমাণে রপ্তানি।

চাষিরা বলছেন, এক বছর আলুর দাম উঠলে আরেক বছর নেমে যায়। লাভ-লোকসানের এই চক্রের সঙ্গে তারা আর পেরে উঠছেন না। অনেকেই লাভের আশায় চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে গোলআলুর চাহিদা ৮৫-৯০ লাখ টন। কিন্তু ২০২১ সালে উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৬ লাখ টন। এ বছর ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৬ লাখ ৫১ হাজার টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে। ২০২০ সালে দেশে ৯৫ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছিল। করোনাকালে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সারাদেশে ত্রাণকার্যে আলু বিতরণ হয়। ফলে শেষের দিকে আলুর সংকট দেখা দেয় এবং দামও চড়া হয়। রাজধানীর বাজারে বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা কেজিতে।
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ গনমাধ্যমকে বলেন, উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য বহুমুখীকরণ না হওয়ায় উৎপাদিত আলুর বড় অংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকও ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ জন্য রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি একটি মূল্য কমিশন গঠন করা দরকার। তাহলে মাঠ পর্যায়ের চাষি ন্যায্যমূল্য পাবেন।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন পুষ্টি বলেন, ২০২০ সালে চাষিরা ভালো দাম পেয়েছিলেন। তাই পরের বছর বেশি চাষ করেছেন। কিন্তু গত বছরের মতো এবারও আলুর দাম একেবারে নিম্নমুখী। গত বছর প্রায় ২০ লাখ টন আলু কোল্টস্টোরেজে উদ্বৃত্ত থেকে গেছে। এবারও সংরক্ষিত আলু বাজারজাত না করতে পারলে বিপুল পরিমাণ আলু অবিক্রীত থেকে যাবে। ন্যায্যমূল্য না পেলে চাষিরা আগামীতে আলু চাষে নিরুৎসাহিত হবেন। আলুর বাজারমূল্যে এই বিপর্যয় ঠেকাতে প্রক্রিয়াজাত কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি ও রপ্তানির উদ্যোগ দরকার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক লাখ দুই হাজার টন আলু রপ্তানি হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি হয় প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের। সেটি কমতে কমতে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ৫৬ হাজার টনে নেমেছে। এক সময় বেশি রপ্তানি হতো মালয়েশিয়ায়। এ ছাড়া রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, ব্রুনাই, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে আলুর চাহিদা ছিল। আলুতে ব্রাউন রোড ডিজিস নামের এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ধরা পড়ায় রাশিয়া আলু নেওয়া বন্ধ করে দেয়। রাশিয়ার সেই আপত্তি নিরসন হয়েছে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, ব্যাকটেরিয়ামুক্ত আলু উৎপাদনের বিষয়টি রাশিয়াকে ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে। এ মুহূর্তে এক লাখ টন আলু রপ্তানির কথা ভাবছে সরকার। বিশ্বের কোন কোন দেশে বাংলাদেশি আলুর চাহিদা রয়েছে, তা জানাতে সব দেশের মিশনগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নতুন আলু বাজারে উঠলেও কৃষকদের ন্যায্য দাম না পাওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, নতুন আলু বাজারে আসতে শুরু করেছে। সে কারণে আলুর দাম কিছুটা কমেছে। মূল্য স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এ ছাড়া সংকট দূর করতে ২০২৫ সাল নাগাদ আড়াই লাখ টন আলু রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে খসড়া রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। রোডম্যাপে বলা হয়, নিম্নমানের আলু উৎপাদন, যথোপযুক্ত প্রত্যয়ন ও অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবের অভাব, পরিবহন সমস্যা, আলু রপ্তানিতে উচ্চহারে ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায় এবং কুলিং চেম্বার, কোল্ডস্টোরেজ, কুলিং ভ্যানের অপ্রতুলতা রয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে অনেকগুলো উন্নত জাত আনা হয়েছে। জাত নিয়ে আর সমস্যা থাকবে না। রপ্তানি উপযোগী ১৮টি আলুর উন্নতজাতের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন