ঢাকা শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Motobad news

মাদক কারবারে মাজার ব্যবহার, আড়ালে থাকতে ‘কাটআউট’ কৌশল

 মাদক কারবারে মাজার ব্যবহার, আড়ালে থাকতে ‘কাটআউট’ কৌশল
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

রাজধানীতে মাদকের কারবার নির্বিঘ্নে চালাতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে অপরাধীরা। তারা ব্যবহার করছে মাজারকে, নিজেদের আড়ালে রাখতে নিচ্ছে ‘কাটআউট’ কৌশল। কারবারিরা গ্রেফতার এড়াতে পারস্পরিক পরিচয় ছাড়াই মাদক সরবরাহ ও অর্থ লেনদেন চালিয়ে যেতে যে কৌশল নিয়েছে, সেটিকেই ‘কাটআউট’ বলা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর মাদক ব্যবসার অন্যতম হোতা মো. আব্দুল্লাহ মনির ওরফে পিচ্চি মনির (৩৩) ও তার সহযোগী মো. জুবায়ের হোসেনকে (৩৩) রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বিদেশি অস্ত্র, ইয়াবা ও নগদ অর্থ।

এ দুজনকে নিয়ে শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন বাহিনীর সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। সেখানেই মাদক কারবারিদের নতুন এসব কৌশলের কথা তুলে ধরা হয়।

খন্দকার আল মঈন বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব-২ এর একটি দল হাজারীবাগ থানা এলাকার মধুবাজারের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে ঢাকার আব্দুল্লাহ মনির ওরফে পিচ্চি মনির ও তার সহযোগী জুবায়ের হোসেনকে গ্রেফতার করে। অভিযানে জব্দ করা হয় দুটি বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিন, ১২ রাউন্ড তাজা গুলি, ১৮ হাজার ৭৭০ পিস ইয়াবা, ৬ গ্রাম আইস এবং মাদক বিক্রির নগদ চার লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার মনির মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায় সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

ফলের ব্যবসা ছেড়ে ইয়াবা কারবারে পিচ্চি মনির
ব্রিফিংয়ে বলা হয়, গ্রেফতার পিচ্চি মনিরের পরিবার জীবিকার সন্ধানে ১৯৯৫ সালে ঢাকায় আসে এবং লালবাগ থানার শহীদনগর এলাকায় বসবাস শুরু করে। মনিরের বাবা চাতক শাহ জীবিকা নির্বাহের জন্য ফলের ব্যবসা শুরু করেন। মনির তাকে সহযোগিতা করতেন। এক সময় মনির এলাকার বখে যাওয়া ছেলেদের সঙ্গে চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তিনি এলাকার বখাটেদের নিয়ে লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জ থানা এলাকায় একটি অপরাধ চক্র গড়ে তোলেন। চক্রের হাত ধরে নামেন মাদক কারবারে।

 

ইয়াবা আনতেন টেকনাফ-কক্সবাজার থেকে
২০১২ সাল থেকে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় মনির ও তার জনৈক বন্ধু অংশীদারত্বের ভিত্তিতে মাদক ব্যবসায় জড়ান। প্রথমে স্থানীয় মাদক ডিলারদের কাছ থেকে অল্প অল্প করে মাদক কিনে খুচরা সেবনকারীদের কাছে বেচতেন মনির। ২০১৬ সাল থেকে নিজেই কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লেনদেন শুরু করেন। গড়ে তোলেন নিজস্ব মাদক নেটওয়ার্ক। এরপর টেকনাফ ও কক্সবাজার থেকে তার কাছে নিয়মিত ইয়াবাসহ মাদক আসতো। মাঝে মধ্যে তিনি ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঢাকা থেকে কক্সবাজার গিয়ে সেখান থেকে মাদকের চালান নিয়ে ফিরতেন। তারা অর্থ লেনদেন করতেন মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে। ২০ শতাংশ হারে অগ্রিম অর্থশোধের মাধ্যমে ইয়াবা ঢাকায় আনতেন তারা।

ছদ্মবেশে ইয়াবার চালান পৌঁছে দিতেন মনিরের ডিলাররা
গ্রেফতার মনির জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে জানান, প্রতিমাসে তিনি কয়েকটি চালান টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আনতেন। রাজধানীর মিরপুর-১৩, ইসলামবাগ, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, আজিমপুরসহ আরও কিছু এলাকার কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ীর সঙ্গে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক সরবরাহ করতেন। প্রত্যেক খুচরা বিক্রেতার জন্য ভিন্ন ভিন্ন মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন। মনির বিশ্বস্তদের নিজের ভাড়া বাসায় নিয়ে মাদকের লেনদেন করতেন, কাউকে সুবিধামত স্থানে ডেকে নিতেন। ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় ভাড়াটিয়া ছদ্মবেশে মাদকের গোপন কারবার চালাতেন তিনি। কখনো ফুলের তোড়া বা প্যাকেটের আড়ালে মাজারে পৌঁছে দিতেন ইয়াবার চালান। সেখান থেকে ডিলাররা নিয়ে পৌঁছে দিতো গন্তব্যে।

মাদক কারবারে ‘কাটআউট’ কৌশল
ব্রিফিংয়ে বলা হয়, নিজের ও ইয়াবার কারবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের স্বার্থে কৌশল হিসেবে মনির ও তার সহযোগীরা অন্য কারবারিদের সঙ্গে পারস্পরিক পরিচয় রাখতেন না। শুধু তাই নয়, রাজধানীর মিরপুর-১৩, ইসলামবাগ, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, আজিমপুরে তার ডিলাররা কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো আটটি মোবাইল ফোন থেকে। ব্যবহার করতো ভিন্ন ভিন্ন সিম। যেন ডিলারদের মধ্যে পরিচয় না হয়।


এক বাসায় বেশিদিন থাকতেন না
২০২০ সালের ডিসেম্বরে হাতিরপুল এলাকায় দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া করা বাসা থেকে অস্ত্র ও ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে গ্রেফতার হন মনির। এ সময় তিনি এক বছর কারাবরণও করেন। তারপর থেকে তিনি সাবধান হয়ে যান। মনির একেকটি এলাকায় এক-দুই বছরের বেশি অবস্থান করতেন না।

ইয়াবা কারবারে বাবার নামে মাজার
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার মনির শরীয়তপুরে নিজ বাড়িতে কোটি টাকার স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। তিনি তার মৃত বাবার কৃতি সন্তান, এমনটিই জনসাধারণকে জানানো ও এলাকায় প্রচারের উদ্দেশ্যে মাদক ব্যবসার অবৈধ টাকা দিয়ে বাবার কবর ঘিরেই একটি মাজার নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। র‌্যাব জানতে পেরেছে, ওই মাজার গড়া হচ্ছে ইয়াবা কারবারের জন্য। আড়ালে মাদকসেবী ও মাদক কারবারিদের হাব হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গড়া হচ্ছে মাজারটি।

ইয়াবার পাশাপাশি ২০১৮ সালে নামেন অস্ত্র কারবারে
গ্রেফতার মনির ২০১৮ সাল থেকে অস্ত্র কারবার শুরু করেন। তিনি ২০১৮ সালে অবৈধ পিস্তলসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং সাত মাস কারান্তরীণ ছিলেন। তার নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় অস্ত্র ও মাদক সংক্রান্ত তিনটি মামলা রয়েছে। মাদক কারবারের পাশাপাশি নিজের নিরাপত্তা ও প্রভাব বিস্তারের জন্য অস্ত্র ব্যবহারও করতেন মনির।

 

সর্বশেষ ইয়াবা-আইসের চালান আসে বিমানে
কক্সবাজার থেকে মনির বিভিন্ন উপায়ে ইয়াবা আনতেন। কখনো কখনো কক্সবাজার-টেকনাফের কারবারিরা নিজেরাই ঢাকায় এসে ইয়াবা দিয়ে যেতো। তবে সর্বশেষ ইয়াবার চালান এসেছে বিমানে। সেই ইয়াবা আনা হয় কার্বন পেপারে প্যাঁচিয়ে। ২০০ পিস ইয়াবা প্যাকিং করে কারবারিদের মাধ্যমে মনির রাজধানীর আটটি জোনে সরবরাহ করেন। মাদক কারবারের অর্থ তিনি পাঠাতেন বিকাশে, কখনো টেকনাফ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের নগদ টাকাই দিয়ে দিতেন।

বিমানে কীভাবে ইয়াবা আসছে জানতে চাইলে র‌্যাবের কর্মকর্তা মঈন বলেন, আমরা কক্সবাজার থেকে ইয়াবা নিয়ে আসা দুজনের এয়ার টিকেট পেয়েছি, যারা মনিরের কাছে ২০ হাজার পিস ইয়াবার চালান ও ৫০ গ্রাম আইস পৌঁছে দিয়েছেন। মনিরের বক্তব্যেও উঠে এসেছে যে—বিমানেই এসেছিল সেই চালান। তবে সেটি তদন্তসাপেক্ষ।


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন