ভর্তি বাণিজ্যের পর বরিশালের স্কুলগুলোতে এখন চলছে সেশন ফি আদায়

বছরের শুরুতেই প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ভর্তির জন্য শ্রেণি ভেদে ৩১০০ টাকা থেকে চার হাজার টাকা করে আদায় করা হয়েছে বেসরকারি অধিকাংশ স্কুলে। এখন বছরের মাঝখানে এসে আবার শুরু হয়েছে সেশন ফি’র নামে আরো আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা আদায়। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় সবকিছু সহ্য করে স্কুল কর্তৃপক্ষের এসব অন্যায় আবদার বছরের পর বছর মেনে নিচ্ছেন অভিভাবকরা। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন পরীক্ষায় ৫০০-৭০০ টাকা করে ফি আদায়। কিন্তু প্রশাসন নির্বিকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালের নামীদামী উদয়ন স্কুল, পানি উন্নয়ন বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার নামে এরকম রমরমা বাণিজ্য চলছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। এর মধ্যে এসব বিভিন্ন কৌশলে টাকা আদায়ে এগিয়ে আছে উদয়ন স্কুল।
অভিভাবকরা জানান, বিদ্যা শিক্ষার নামে এসব প্রতিষ্ঠানে চলছে পুরোমাত্রায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম। শিক্ষকরা নৈতিকতা ভুলে শিক্ষার্থীদের ব্যবসার পণ্য হিসেবে গণ্য করছে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে কখনোই সুসম্পর্ক স্থাপন হবে না।
ভুক্তভোগী একাধিক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অনেক স্কুলে বেতন দেওয়ার রশিদ বইও নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এছাড়া রশিদে উল্লেখ করা বিদ্যুৎ বিল, কম্পিউটার ল্যাব, খেলাধুলা, পাঠাগার, নেম প্লেট, দরিদ্র তহবিলসহ সিলেবাস ও প্রসপেক্টাস ফিও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। এছাড়া স্কুলে কোচিং বাণিজ্য তো আছেই। কিন্তু কারো কিছু বলার নেই। অভিভাবকরা সন্তানের কথা চিন্তা করে কেউ কিছু বলছে না।
আবার এমন অনেক স্কুল আছে যারা গত পাঁচ-দশ বছরেও ম্যাগাজিন প্রকাশ না করলেও প্রতি বছর এজন্য ফি আদায় করছে। ফি নেয়া হচ্ছে মিলাদের নামেও।
উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, বরিশালের ঐতিহ্যবাহী এই স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করার পর পর্যায়ক্রমে নানা বাহানায় একের পর এক খাত দেখিয়ে টাকা আদায় করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে প্রত্যেক ক্লাসে প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সেশন ফি আদায় করা হচ্ছে। কেউ দিতে না পারলে তাদেরকে বেতনের সঙ্গে বাড়িয়ে টাকা তুলে নিচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না বলে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
সরেজমিনে বুধবার ও বৃহস্পতিবার নগরীর একাধিক স্কুল ঘুরে এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, চলতি বছরে সপ্তম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ভর্তি ফি ৩০০০ টাকা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে স্কুলের বিভিন্ন উন্নয়নমূল কাজের জন্য সেশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩০০ টাকা। এছাড়া এসব ক্লাসে ১০০ টাকা বেতন বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। যা গতবছর ছিল ৫০০ টাকা। অন্যদিকে এই বিদ্যালয়ের আরেকটি প্রাথমিক শাখা রয়েছে চৌমাথা এলাকায়। সেখানের শিশুদের কাছ থেকেও জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে।
অতিরিক্ত সেশন ফির নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নিকুলাস টলেন্ট টিনু বলেন, সেশন ফিগত বছরের তুলনায় প্রায় ৮০০ টাকা কমিয়ে ২৩০০ টাকা করা হয়েছে। তবে স্কুলের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের স্বার্থে সরকারী নীতিমালার চেয়ে সেশন ফি একটু বেশি নেয়া হয়। তিনি বলেন, সেশন ফি কমিয়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করে বেতন ১০০ টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
তবে একাধিক অভিভাবক বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্কুলের কেউ অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে না। বরং প্রভাবশালী স্থানীয় একটি গোষ্ঠীকে ম্যানেজ করেই স্কুল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ফলে প্রশাসনও এ বিষয়ে নির্বিকার।
একই দৃশ্য দেখা গেছে নগরীর বান্দ রোড পানি উন্নয়ন বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা নেয়া না হলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেশন ফি ২০০০ টাকা নেয়া হয়েছে। তবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিনের দাবি, সেশন ফি নির্ধারণ করা হলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। তাই শিক্ষার্থীদের জোর করা হয় না।
নগরীর পলাশপুর আলহাজ দলিল উদ্দিন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেশন ফি ১৪০০ টাকা এবং ভর্তি ১০০০ টাকা নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে স্কুলে ৬০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের ভিতরে অধিকাংশ নিন্ম শ্রেণীর। সেশন ফি ভর্তি বইতে উল্লেখ থাকলেও পুরো টাকা অনেক শিক্ষার্থী দিতে পারে না। আবার অনেকেই দেয় না।
এদিকে নগরীর নবগ্রাম রোডের ছাবেরা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, এই স্কুলে ভর্তিসহ সেশন ফি নেয়া হয়েছে ১৩০০ টাকা। আর প্রতিমাসে বেতন বাবদ ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ১২০ টাকা, ৭ম শ্রেণিতে ১৫০, ৮ম শ্রেণিতে ১৮০ এবং ৯ম ও ১০ শ্রেণিতে ২০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুভাস চন্দ্র সরকার এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, গত বছর ভর্তিসহ সেশন ফি যে টাকা নির্ধারিত তাই নেয়া হয়েছে।
নগরীর আলেকান্দা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ৫০০ টাকা হলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেশন ফি ১০০০ টাকা নেয়া হয়েছে।
এছাড়া বেতন বাবদ ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ২০০ টাকা এবং ৯ম শ্রেণিতে ২৫০ ও ১০ম শ্রেণিতে ৩০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, সরকার নির্ধারিত নিয়মের ভিতরেই বিদ্যালয় পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিবছরই একই নিয়মে সেশন ফি নির্ধারিত রয়েছে। এসব বিদ্যালয়েই নয়, একই চিত্র প্রায় নগরীর নামীদামি প্রতিটি স্কুলেরই।
বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক গাজী জাহিদ হোসেন বলেন, এসব স্কুলে এ ধরনের ঘটনা বছরের পর বছর ধরে চললেও কেউ কিছু বলে না। মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের এসব দেখার কথা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগের শেষ নেই। ফলে এসব দুর্নীতি দিনের পর দিন বাড়ছেই। তাদের সম্মতি না থাকলে এভাবে সবার চোখের সামনে এই বাণিজ্য চলতে পারে না।
তিনি আরো বলেন, এদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলেও তারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে প্রশ্রয় পায়। তাই তাদের কখনো কিছু হয় না।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বরিশাল বিভাগীয় আহবায়ক অধ্যাপক মহসিন উল ইসলাম হাবুল বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে ভর্তিবাণিজ্য সারাদেশে অব্যাহত আছে। আমরা এসব প্রতিরোধে সবসময়ই সোচ্চার। এসব বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে আগামী ২ জুন আমাদের কমিটির সভা আহবান করা হয়েছে। সেখানে এসব বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে আলোচনা করে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আকারে প্রস্তাব জমা দেওয়া হবে।
উদয়ন স্কুল ও আলহাজ দলিল উদ্দিন মাধ্যমকি বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রভাব খাটিয়ে এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে জানান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বরিশালের আঞ্চলিক উপ-পরিচালক মাহবুবা হোসেন। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।
এমএন