বরিশালে জমজমাট মাদক বাণিজ্য!

৩০টি ওয়ার্ড নিয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশন গঠিত। বর্তমানে প্রতিটি ওয়ার্ডে চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য চলছে বরিশাল মেট্রোপলিটন এয়ারপোর্ট ও কাউনিয়া থানা এলাকায়। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেলের তথ্য মতে, গত ফেব্রয়ারি থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত নগরী থেকে ৫৩ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে।
তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪২ কেজি ৮৫০ গ্রাম গাঁজা ও ১ হাজার ৮৮১ পিস ইয়াবা। এর মধ্যে এয়ারপোর্ট থানা পুলিশের অভিযানে আটক হয়েছে ২২ জন মাদক ব্যবসয়ীকে। যা অন্যান্য ওয়ার্ডের চেয়ে সংখ্যায় সর্বোচ্চ।
আটকৃতদের মধ্যে অধিকাংশই কারাগারে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন মিডিয়া সেলের উপ পরিদর্শক (এসআই) তানজিল আহমেদ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীসহ তার আশপাশে অর্ধশতাধিক মাদকব্যবসায়ী ইয়াবা, গাঁজা ও ফেনসিডিল বিক্রি করে আসছেন।
এর মধ্যে কাউনিয়া থানাধীন এলাকার ভাটিখানা, রসুলপুর কলোনি, বিসিক বেঙ্গল ফ্যাক্টরি, কমিশনার গলি, আরজুর মনি বিদ্যালয় সংলগ্ন, বাসু মিয়ার গলি, আমানতগঞ্জ, পলাশপুর, বাসের হাট খোলায় মাদকের বিস্তার খুব বেশি।
এসব এলাকায় মাদক বিক্রি করচ্ছেন, কাউনিয়ার পান্থ সড়কের হাতকাটা নিজাম, পশ্চিম কাউনিয়ার খালপার বস্তির সাজন ও শাওন, পলাশপুরের বৌ-বাজার এলাকার গাঁজা কালাম, পলাশপুর ৭ নম্বর গলির রিপন, পলাশপুর ২ নম্বর গলির ইসমাইল, কাউনিয়ার শিশুপার্ক কলোনির বাডি মিরাজ, ৪নম্বর পলাশপুর ভোজা রাকিব, ৫নম্বর পলাশপুর জামাই বাজারে স্বপন ও শাকিল, ১নম্বর পলাশপুর ডগ স্বপন, ২নম্বর পলাশপুর পেডা শাহীন, ভাসাই, রাজিব-আঁখি দম্পতি, মোহাম্মদপুর এলাকার জনি মাদক ব্যবসা করছে।
এর বাইরেও বাউয়া সোহাগ, ভাঙারি সোহেল, ময়লাখোলা এলাকায় রাশেদ-লাবণী, বাসু মিয়ার গলির বাসিন্দা ভাঙারি রাশেদ ও মুন্নি, বিসিক কমিশনার গলি মীরা সোহেল, কাউনিয়া হাউজিং এলাকার মজনু, বিসিক বাস্তুহারা কলোনির সজল ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করছে। তালতলি এলাকায় রাসেল মেম্বার ইয়াবার পাইকারি বিক্রেতা। চরবাড়িয়া ইউনিয়নের চরআবদানী গ্রামের লোড সুমন, কামাল ওরফে গাঁজা কামাল, তার স্ত্রী নাসিমা বেগম ও নুপুর ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করছে।
এছাড়া এয়ারপোর্ট থানাধীন গনপাড়া, লাকুটিয়া, রুইয়ার পোল, সোনামিয়ার পোল, বারৈজ্জারহাট, কাশিপুর, কুদঘাটা, দিয়াপাড়া, ইছাকাঠী, মাদবপাশা, নতুন হাট, মোহনগঞ্জ এলাকায় অলিগলিতে ছেয়ে গেছে মাদক। এসব এলাকার অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী চহটা গ্রামের চডা রাসেল। নথুল্লাবাদের ফেন্সি বাবুল, কাশিপুরের জাহিদ ও সজল, কড়াপুরের মিলন আকন ইয়াবা ও ফেনসিডিল বিক্রি করে আসছে।
এছাড়া নগরীর গোড়া চাঁদ রোড, কলেজ এভিনিউ, গোরস্তানরোড, ফকির বাড়ী রোড, কালিবাড়ী সড়ক, সাগরদি ধানগবেষণা সড়ক, লালাদিঘির পাড়, রূপাতলী আহম্মেদিয়া মোল্লা সড়ক, বসুন্ধারা হাউজিং, চাঁদমারী স্টোডিয়াম বস্তি, কেডিসি বস্তি, রিফুজি কলোনী, কালুসা সড়ক এলাকায় হরআমেশা মাদকের বেচাকেনা হচ্ছে।
এর মধ্যে নগরীর রূপাতলী এলাকায় ফয়সাল, স্টেডিয়াম কলোনির বাপ্পি, ওয়াপদা কলোনির সোহেল, রসুলপুরের কমলা ও তার স্বামী, একই এলাকার লিপি ও তার স্বামী পলাশ, কেডিসি এলাকার নাজমা ও তার স্বামী নজরুল মাদক ব্যবসা চালাচ্ছে। তারা ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রির সঙ্গে জড়িত। ভাটারখাল এলাকার যুথী-মুন্না দম্পতি, কেডিসি এলাকার নীলু, টিঅ্যান্ডটি কলোনির কালু, বাংলাবাজার এলাকার গাঁজা রফিক ও তার শ্যালক আরমান।
নাজিরপুল এলাকার খাটো জামাল, রফিক, নজরুল, সিঅ্যান্ডবি রোডের মাইজ্জা কামাল ও জামাল, শেরেবাংলা সড়কের রিয়াজুল, বিএম কলেজের দেলোয়ার হোসেন দিলু। এরা সবাই গাঁজা বিক্রেতা। এছাড়া নতুন বাজার এলাকার বেবি, হারুন ও তাদের ছেলে রাকিব ফেনসিডিল বিক্রি করছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বন্দর থানার চরকাউয়া মুসলিম পাড়া এলাকার রাজু-লাকি দম্পতি, চরকাউয়া বড়ইতলা এলাকার কবির, ছোট্ট ওরফে রনি, চরকাউয়া খেয়াঘাট মিলন, চরকাউয়া জিরোপয়েন্ট এলাকার হাড্ডি সোহাগ দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করছে।
এছাড়াও চরআইচা এআরখান এলাকার মিজান ও তার ছেলে জিয়া, কর্নকাঠী চৌমাথা এলাকার রুবেল, রাজিব, শুভ, চরকরঞ্জি এলাকার রিশাদ, শাহ আলম, দিনারের পোল এলাকার শাওন ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রির সঙ্গে জড়িত।
সূত্র জানায়, সড়কপথে মাদকের চালান বহন ও প্রবেশে চাপ সৃষ্টি হলেই নদীপথ বেছে নেন মাদক কারবারিরা। সড়কপথে মাদকের চালান বহনে অতিরিক্ত প্রশাসনিক তল্লাশিতে ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু নদীপথে মাদকের চালান বহনে তেমন কোনো চেকিং অসুবিধায় পড়তে হয় না। নদীপথে নদীর সীমানা বড় হওয়ায় নৌপুলিশ বা অন্য বাহিনীগুলোর তেমন একটা টহল দেখা যায় না।
এছাড়া নদীপথে মাদকের চালান বহনে নানা কৌশল অবলম্বন করেন মাদক কারবারিরা। ট্রলারে বহনকৃত বালুর নিচে লাখ পিস ইয়াবা নিয়ে এলেও তা নির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া আটক সম্ভব না। এতে বিভিন্ন নৌযানে অবাধে প্রবেশ করছে মাদক। তবে প্রায় সময় প্রশাসনিক অভিযানে ইয়াবা ও গাঁজার বড় চালান আটক হয়েছে। তারপরেও কমেনি মাদক বেঁচাকেনা।
একাধিক সূত্র জানায়, মাদক ইয়াবার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের নেতারাও। একটি গ্রুপ রয়েছে যারা দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ছবি তুলে শোডাউন করে বেড়ায়। রাজনীতিকরা এসব মাদকের আশ্রয়দাতা ও তাদের কর্মীদের রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার দাপটে ওই গ্রুপটি নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভ্রাম্যমাণ টিমের মাধ্যমে ইয়াবার কারবার করে যাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, শুধু ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন নেতাই নন, মাদকের কারবার থেকে প্রতি সপ্তায় মোটা অঙ্কের চাঁদা নিচ্ছে প্রশাসনের একটি অসাধু মহল। ওই অসাধু কর্তারা সরাসরি মাদকে জড়িত হচ্ছেন না বা চাঁদার টাকা আদায় করছেন না। তাদের সোর্সেরা মাদক কারবারিদের কাছ থেকে চাঁদার টাকা আদায় করছেন। এতে অনেকটা প্রকাশ্যে ও বেপরোয়াভাবেই চলছে নগরজুরে মাদকের কারবার।
বরিশাল সচেতন নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, মাদকের প্রভাবে মেধাবী তরুণরা বিপদগামী হচ্ছে। মাদক থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হলে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার।
এ বিষয়ে বরিশাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এনায়েত হোসেন বলেন, এদের সবার বিরুদ্ধেই একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে আমাদের বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত কাজ করছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের নগর গোয়েন্দা শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, মাদক কারবারিরা যতই শক্তিশালী হোক তাদের সমূলে নির্মূলে আমরা কাজ করছি।
এ ব্যাপারে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জিহাদুল কবির বলেন, প্রতিদিনই মাদকসহ জড়িতদের আটক করা হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে জড়িত কারো প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
এইচকেআর