ঢাকা বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫

Motobad news

৮ শতাংশ কমতে পারে ধান উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তায় চাপ বাড়বে

৮ শতাংশ কমতে পারে ধান উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তায় চাপ বাড়বে
২০৫০ সালের মধ্যে ধান উৎপাদন ৮ শতাংশ কমে যেতে পারে/ ফাইল ছবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলাদেশের কৃষি খাত আবারও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে। প্রাকৃতিক ও অ-প্রাকৃতিক দুই ধরনের চাপই ক্রমশ কৃষিতে উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা, অনিশ্চিত বৃষ্টিপাত, বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা এবং অব্যবস্থাপনা, যন্ত্রায়নের ধীরগতি ও ফসলের অল্প বৈচিত্র্য- সব মিলিয়ে দেশের কৃষি এখন বহুমাত্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন কমে যেতে পারে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ, যা খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে আসে। মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠেয় সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের সচিব এস এম শাকিল আখতার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক প্রফেসর এ কে এনামুল হক। এতে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ ইউনুস।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর মারাত্মক পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাপমাত্রা বছরে বছরে বাড়ছে, মৌসুমি বৃষ্টিপাত কখনো অতিরিক্ত, কখনো সম্পূর্ণ অনিয়মিত। এতে ধান, গম, ভুট্টাসহ প্রধান খাদ্যশস্যের জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মাঠে কাজ করা শ্রমিকদের ওপরও তাপমাত্রার সরাসরি প্রভাব পড়ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় তাপপ্রবাহের কারণে কৃষি শ্রমঘণ্টা কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এতে উৎপাদনশীলতা কমছে, জমি প্রস্তুত করতে সময় লাগছে বেশি। পাশাপাশি শ্রম ব্যয়ও বাড়ছে দ্রুত।

সবচেয়ে বড় সংকট দেখা যাচ্ছে বোরো ধানের উৎপাদনে। বিগত কয়েক বছর ধরে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো সতর্ক করে আসছে যে বোরো মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির হার স্থবির হয়ে গেছে। নতুন হাইব্রিড, পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি বা লবণাক্ততা সহনশীল জাত না নিলে ভবিষ্যতে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমটি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত সার, কীটনাশক ও রাসায়নিকের সীমাহীন ব্যবহার এখন ভূমি ও পানির গুণগত মান নষ্ট করছে। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানিতে নাইট্রেট ও ফসফেটের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কৃষিকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। চাষিরা দ্রুত ফলনের আশায় বেশি সার ব্যবহার করছেন, কিন্তু দিনে দিনে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে উৎপাদন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু সংক্রান্ত বিশ্লেষণ বলছে, ভবিষ্যতের কৃষি ব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে এখনই বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে- ফসল বৈচিত্র্য, আধুনিক কৃষিযন্ত্র, পানি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, গবেষণানির্ভর নতুন জাত ও টেকসই কীটনাশক ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। অন্যথায়, ২০৫০ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের মহাপরিচালক এনামুল হক বলেন, কৃষিতে মূল্য সংযোজন ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যা দারিদ্র্য হ্রাসে বিভিন্ন ফসলের সম্মিলিত অবদান শক্তিশালী করেছে। তবে ধানের মতো যেসব বাজারে সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে দারিদ্র্য কমার প্রভাব তুলনামূলক কম। শ্রমশক্তি বেশি হলেও কৃষকের লাভ সীমিত থাকায় তারা এখন বেশি ঝুঁকছেন চুক্তিভিত্তিক চাষে। এছাড়া ইউরিয়া সারের ব্যবহার বাড়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, যদিও প্রমাণ এখনো চূড়ান্ত নয়। এডব্লিউডি প্রযুক্তি কৃষকের খরচ বাড়ায় বলে গ্রহণযোগ্যতা কম। জলবায়ু পরিবর্তনও কৃষিতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা সচিব শাকিল আখতার বলেন, বাংলাদেশের কৃষি তথ্যব্যবস্থায় বড় ধরনের গরমিল রয়েছে। বিবিএস ও খামারবাড়ির তথ্য এক নয়, অথচ এ দুটি প্রতিষ্ঠান একই এলাকার মধ্যে। সঠিক সমন্বয় না থাকায় ফসল উৎপাদনের তথ্যও নির্ভরযোগ্য থাকে না। তিনি উল্লেখ করেন, কৃষকের জন্য প্রতিবছর বড় অঙ্কের প্রকল্প নেওয়া হলেও কতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় তা স্পষ্ট নয়। অনেক কৃষি প্রকল্পে খরচ অযথা বাড়ে এবং ফেজ শেষ হওয়ার পর কাজ আর এগোয় না। একটি কৃষি ইনস্টিটিউশনের প্রকল্পে বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আনার অযৌক্তিক ব্যাখ্যাও তিনি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। এসব কারণে কৃষি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন