নিজেদের ফাঁদেই ধরা হানিট্র্যাপ চক্রের নারীসহ দুই সদস্য

দীর্ঘদিন ধরেই বরিশাল নগরীতে একের পর এক হানিট্র্যাপের শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন বয়সী যুবক। তাদের থেকে চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অবশেষে সেই চক্রের সন্ধান মিলেছে দৈনিক মতবাদের অনুসন্ধানে।
দীর্ঘ দুই মাস অনুসন্ধানের পর চক্রের দুই সদস্যকে টিম মতবাদের সহযোগিতায় আটক করেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ। শনিবার (০৬ ডিসেম্বর) বিকেলে নগরীর নিউ ভাটিখানা এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এদের মধ্যে একজন নারী এবং অপরজন ভুয়া সাংবাদিক পরিচয়ধারী যুবক।
চক্রের আটককৃত সদস্যরা হলেন- ১৯ বছর বসয়ী তরুণী বরিশাল নগরীর কাউনিয়া এলাকার ভাড়াটিয়া বাসিন্দা নিশি আক্তার (ছদ্ম নাম)। অপরজন নিউ ভাটিখানা এলাকার বাসিন্দা নোহান ইসলাম রিমন (২০)। তিনি নিজেকে অনুসন্ধান বিডি টোয়েন্টিফোর এবং ডেইলি বরিশাল সংবাদ নামের একটি নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক পরিচয় দেন। এসময় তার কাছ থেকে একটি মাইক্রোফোন (বুম) ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়।
দুই মাস আগে হানিট্র্যাপের ফাঁদে পড়েন নগরীর এক যুবক। তার কাছ থেকে ৫২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় হানিট্র্যাপ চক্রটি। সেই যুবক স্মরণাপন্ন হন মতবাদের। এরপর শুরু হয় হানিট্র্যাপ চক্রের বিরুদ্ধে মতবাদ টিমের অনুসন্ধান। নিজে থেকেই চক্রের ফাঁদে জড়ান মতবাদের একজন সহকর্মী। নিজেকে পটুয়াখালীর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পরিচয়ে গত দুই মাস ধরে চক্রের সাথে যোগাযোগ করেন তিনি। একপর্যায় তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় চক্রের নারী সদস্য। এমনকি হঠাৎ করেই শনিবার রাতে তাকে নিয়ে রুম টেডেটের প্রস্তাব দিয়ে রোববার বরিশালে ডাকেন চক্রের সদস্যরা।
চক্রের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী মতবাদের সহকর্মীকে শনিবার দুপুর ২টার দিকে বরিশাল নগরীর নবগ্রাম রোড এলাকায় আসতে বলা হয়। তবে ২টা বাজার কিছু সময়ের মধ্যেই জায়গা বদলে নেয় চক্রের সদস্যরা। দেখা করতে বলা হয় নগরীর নাজিরের পুল এলাকায়। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয় মতবাদ টিম।
পরে নাজিরমহল্লা এলাকা থেকে মতবাদের সহকর্মীকে রিকশায় তুলে অজ্ঞাত স্থানে রওয়ানা হয় চক্রের মুখে মাক্সপড়া নারী সদস্য। পরে নিউ ভাটিখানা এলাকায় রুনা ও রানার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। এরপর শুরু হয় চক্রের কার্যক্রম। অনুসন্ধানী টিম কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্রই বিষয়টি টের পেয়ে কেটে পড়ে চক্রের সদস্যরা।
তবে ধরা পড়ে যায় নারী সদস্য নিশি আক্তার। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে হাজির হয় কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশের টিম। এসময় ঘটনাস্থল থেকে হানিট্র্যাপ চক্রের ওই নারী সদস্য এবং একটি মোটরসাইকেলসহ ভুয়া সাংবাদিক রিমনকে আটক করে থানায় নিয়ে যান তারা। ঘটনার সময় ওই যুবক চক্রের সদস্য নন- দাবি করলেও থানায় নেয়ার পর আটক তরুণীই স্বীকার করে রিমনের জড়িত থাকার কথা।
ঘটনাস্থল নিউ ভাটিখানা এলাকার ভাড়াটিয়া তানিয়া আক্তার জানান, গত তিন মাস ধরে ওই বাড়িতে ভাড়া থাকেন তিনি। বাড়িটির মালিক রুনা নামের একজন। শুনেছি তার ভাই রানা কোনো এক মামলার আসামি হওয়ায় আত্মগোপনে রয়েছে। গত তিন মাসে এই বাসায় এমন অনেক নারী-পুরুষকে আসতে যেতে দেখেছি। কিন্তু ধরা পড়ার ঘটনা এটাই প্রথম। তবে ঘটনার পর বাড়ির মালিক রুনাসহ অন্য কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এদিকে- দু’জনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে হানিট্র্যাপ চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য। আটক নিশি আক্তার জানান, তার চক্রের মূল হোতা ‘নীলা পাখি’ নামের এক তরুণী। তার সাথে রয়েছে বৃষ্টি, সামিয়া নামের তিন তরুণী। এছাড়াও সাতরাজ, সার্জিস, রিমন এবং ভাটিখানা এলাকার দালাল শাহিনসহ অনলাইন নিউজ পোর্টালের কয়েকজন ভুয়া সাংবাদিক চক্রের সদস্য।
নিশি জানায়, হানিট্র্যাপ চক্রের কাজ হচ্ছে টাকাওয়ালা বিবাহীত এবং অবিবাহিত যুবকদের ফেসবুকের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে সুবিধামত জায়গায় নিয়ে আসা। আর এই কাজটি করেন নীলা পাখি এবং বৃষ্টি। পরে অন্য মেয়েদের সাথে রুমে পাঠিয়ে চক্রের অন্য সদস্যদের খবর দেয়া হয়। ওইসব ব্যক্তি বা যুবকদের ফাঁদে ফেলার মূল কাজটি করে থাকে সাংবাদিক পরিচয়ধারীরা।
তারা নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বুম নিয়ে মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করে চাহিদা অনুযায়ী মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। টাকা লেনদেনও করেন ভুয়া সাংবাদিকরা। গত ছয় মাসে চক্রটি অন্তত ২০ জনকে ফাঁদে ফেলেছেন বলে দাবি স্বীকার করেন নিশি। এমনকি মতবাদের স্মরণাপন্ন হওয়া যুবককে ফাঁদে ফেলে ৫২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথাও স্বীকার করে নিশি বলেন, শনিবার বিকেলে যাকে নিয়ে ঘটনা তার সাথে যোগাযোগ করেছিল সৃষ্টি। বৃষ্টিই আমাকে ওই যুবকের মোবাইল নম্বর দিয়ে কাজ করতে বলে।
নিশি জানায়, পূর্বে চার হাজার টাকা বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো সে। সেখান থেকে বৃষ্টির মাধ্যমে এই চক্রে ভেরেন তিনি। তাকে চক্রের কার্যক্রম শিখিয়ে দেয় অপর সদস্য সামিয়া। অভাবে পড়ে তিনি এই পেশায় জড়িয়েছেন। যাদের ফাঁদে ফেলা হয় তারা লোকলজ্জা এবং সংসারের ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না। তাই প্রতারণার এমন কৌশল বেছে নিয়েছেন তারা। তবে ইতোপূর্বে কখনো ধরা পড়েননি তিনি। এরপর থেকে আর কখনো এই নোংরা কাজ করবেন না বলেও অঙ্গীকার করেন নিশি।
আটক অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া বরিশাল মেট্রোপলিটনের স্টিমারঘাট ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই এমন অপকর্ম করে আসছিল। সাংবাদিকদের সহযোগিতায় চক্রটিকে আমরা ধরতে সক্ষম হয়েছি। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী এক যুবক বাদী হয়ে থানায় মামলার আবেদন করেছেন। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
এইচকেআর