বরিশাল মহানগর বিএনপি’র নেতৃত্ব চান ছাত্র নেতারা

খুব শীঘ্রই হতে পারে বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপি’র কমিটি। এমন গুঞ্জন এখন দলীয় ফোরামে। দলের শীর্ষ নেতারাও বলছেন কমিটি গঠন কার্যক্রম শুরু করেছে কেন্দ্র।
এমন খবরে দলের পদ প্রত্যাশী নেতারা রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেছেন। আবার রাজনীতিতে সুবিধাবঞ্চিত নেতারাও জোটবদ্ধ হচ্ছেন। তারা দাবি তুলেছেন ত্যাগি এবং বঞ্চিত নেতাদের মূল্যায়নের।
বিশেষ করে বরিশাল মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব সাবেক ছাত্র নেতাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবি ছাত্রদলের সাবেক এবং বর্তমান নেতা-কর্মীদের। এমনকি তাদের এই দাবিতে একাত্মতা জানিয়েছেন বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের অন্য নেতা-কর্মীরাও। আবার দলের দীর্ঘ দিনের নিষ্ক্রিয় নেতারাও চাঙ্গা হয়েছেন এ দাবি নিয়ে। মূলত মহানগর বিএনপিকে রাহুমুক্ত করে আন্দোলন-সংগ্রাম নির্ভর একটি ইউনিট গঠনের দাবি তাদের সকলের।
জানা গেছে, ‘সবশেষ ২০১০ সালে গঠিত হয় বরিশাল মহানগর বিএনপি’র কমিটি। সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ারকে সভাপতি ও অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহীনকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটির পূর্ণতা পায় ২০১৩ সালে। তবে এরপর নতুন করে গঠন হয়নি বরিশাল মহানগর কিংবা জেলা কমিটিও। এরই মধ্যে ২০১৫ সালের দিকে কমিটির সাধারণ সম্পাদক কামরুল আহসান শাহীন ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে ভাগ্য খুলে যায় কমিটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন সিকদারের। তিনিই বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহানগর বিএনপিতে।
দলীয় সূত্র জানায়, ‘মহানগর বিএনপি’র রাজনীতিতে ত্যাগি এবং মেধাবী নেতার মূল্যায়ন হয়নি কখনই। ফলে নতুন নেতৃত্বের বিকাশও ঘটেনি এই ইউনিটে। যদিও এর পেছনে দলের একজন শীর্ষ নেতাকে দায়ী করেন অধিকাংশ নেতাকর্মী। তাদের অভিযোগ ওই নেতার অবমূল্যায়ন এবং অযোগ্যদের মূল্যায়নের কারণে দলের অনেক মেধাবী নেতা রাজপথের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। নতুন কমিটি’র খবরে সেইসব নেতারা আবার জোটবদ্ধ হতে শুরু করেছেন।
দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ‘মহানগর বিএনপিতে এখন মেধাবী এবং গ্রহণযোগ্য নেতার প্রয়োজন। যার নেতৃত্বে মতবিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিবে মহানগর বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠন। এমন নেতৃত্ব গড়তে ছাত্র নেতাদের বিকল্প নেই বলে মনে করেন দলের নেতাকর্মীরা।
দলের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি মজিবর রহমান সরোয়ার বিরোধী শিবিরের বিএনপি নেতাকর্মীরা কয়েক দফা বৈঠক করেছেন মহানগর বিএনপি’র কমিটি নিয়ে। ওই সভায় নেতৃত্বের আলোচনায় উঠে আসেন সাবেক ছাত্র নেতারা। বিশেষ করে মহানগর বিএনপি’র বর্তমান সহ-সভাপতি আখতার হোসেন মেবুল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর জাহিদুল কবির জাহিদ, সহ-সম্পাদক আ.ন.ম সাইফুল আহসান আজিম, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক ও মহানগর ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক খন্দকার আবুল হাসান লিমন, মাকসুদুর রহমান মাকসুদ, আবু মুসা কাজলসহ কয়েকজন নেতার নাম আলোচনায় আসে। উভয় বৈঠকেই মহানগর বিএনপি’র কমিটিতে এসব নেতাদের মূল্যায়ন দাবি করা হয়।
জানা গেছে, ‘মহানগর বিএনপি’র বর্তমান সহ-সভাপতি আখতার হোসেন মেবুল জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ছিলেন। ছিলেন কোতয়ালী শাখার সভাপতি। এছাড়া বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের চার বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর মীর জাহিদ ছিলেন মহানগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং বর্তমানে মহানগর বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এর বাইরে খন্দকার আবুল হাসান লিমন মহানগর ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক, স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ২১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি’র দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ‘ল’ কলেজের সাবেক জিএস এবং বর্তমান মহানগর বিএনপি’র ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
আলাপকালে বৈঠকের কথা স্বীকার করে খন্দকার আবুল হাসান লিমন বলেন, ‘আমাদের সবার দাবি সাবেক ছাত্রদল নেতাদের নিয়েই মহানগর বিএনপি’র কমিটি গঠন হোক। এমনটি হলে মহানগর বিএনপি’র কার্যক্রম আরও চাঙ্গা হবে। কেননা দলের বড় শক্তিই হচ্ছে ছাত্রদল। যারা তৃনমূল থেকে রাজনীতি করে আসছে তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা রয়েছে। তাই সাবেক ছাত্রদল নেতাদের নিয়ে কমিটি করা হলে তারা ভালো ভাবেই দল চালাতে পারবেন। আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে পারবেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার আবুল হাসান লিমন বলেন, ‘মজিবর রহমান সরোয়ার আমাদের নেতা। তার নেতৃত্বেই আমরা সবাই রাজনীতি করেছি। কিন্তু তিনি গুটি]কয়েক নেতা নিয়ে রাজনীতি করছেন। তারাই মজিবর রহমান সরোয়ারকে ঘিরে রেখেছেন। এ কারণেই তিনি মেধাবী এবং ত্যাগিদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের মূল্যায়ন করে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসিয়েছেন। এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মকা- চালাতে গিয়েই মূলত তার সাথে নেতাকর্মীদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
এই নেতা বলেন, ‘পূর্বে মহানগর বিএনপি কোন কর্মসূচি ডাকলে মজিবর রহমান সরোয়ারের নেতৃত্বে হাজার হাজার নেতাকর্মী ওই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। এখন ওই গুটিকয়েক নেতাকর্মী নিয়ে কর্মসূচি পালন করছেন তিনি। যেখানে অঙ্গ সংগঠনের সিংহভাগ নেতাকর্মী তার কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন না। তারা আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করছেন। আমরা চাই মহানগর বিএনপি’র এই অবস্থার পরিবর্তন। এ কারণেই সাবেক ছাত্রদল নেতাদের নেতৃত্বে আনার দাবি আমাদের। সাবেক ছাত্র নেতাদের মূল্যায়ন করা হলে মহানগর বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে পারবে। আর মজিবর রহমান সরোয়ার কেন্দ্রের যুগ্ম মহাসচিব। তার কাছেও আমাদের একই দাবি। যাতে সাবেক ছাত্র নেতাদের নিয়ে মহানগর বিএনপি গঠনের বিষয়ে তিনি কেন্দ্রে সুপারিশ করেন।
সাবেক ছাত্র নেতাদের এই দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে জানিয়ে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিছ আক্তার জাহান শিরিন বলেন, ‘বিএনপি এমন একটা পর্যায়ে এসেছে যেখানে এখন ছাত্র নেতারাই মূল দলের নেতৃত্বে আসছেন। আমাদের বরিশাল জেলাসহ বৃহত্তর বরিশাল বিভাগে এই সংস্কৃতি অনেক আগে থেকেই চালু আছে। এখন ছাত্রনেতারা মহানগর বিএনপি’র নেতৃত্বের দাবি করতেই পারেন। তাছাড়া ছাত্র নেতাদের মাঝে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা রয়েছে। কেননা তারা ছাত্রদল থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা বিএনপি’র নেতৃত্বে আসলে দল আরও গতিশীল হবে বলে আমি মনে করি। তবে কমিটি’র বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ধারণ করবে কেন্দ্র।
তিনি বলেন, পদ চাইলেই যে পাবেন সেটা নয়, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিষয়টি নিজেই মনিটরিং করছেন। তার নির্দেশেই কেন্দ্র থেকে দিক নির্দেশনা আসবে। তবে আমাদের সুপারিশ থাকবে এতটুকুই যে, যারা দুঃসময়ে বিএনপি’র পাশে ছিলেন, আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে ছিলেন এবং নেত্রীর পাশে ছিলেন তাদেরকেই যেন মূল্যায়ন করা হয়।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বিলকিছ আক্তার জাহান শিরিন বলেন, ‘রাজনীতিকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ ভাবলে চলবে না। রাজনৈতিক মনমানসিকতা থাকতে হবে। কেননা আজ চেয়ার আছে তো কাল চেয়ারটি নাও থাকতে পারে। সেটা ভুলে গিয়ে চেয়ারকে নিজের সম্পদ মনে করে যাচ্ছে তাই ভাবলে চলবে না। বিএনপি’র নাম ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের সাথে সখ্যতা গড়ে ব্যবসা বাণিজ্য এবং সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন আর বিএনপিকে কেয়ারফ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এমন সুবিধাবাদীরা যাতে কমিটিতে আসতে না পারেন সে বিষয়েও আমরা কেন্দ্রে সুপারিশ করবো।
বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও মহানগর বিএনপি’র সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘ছাত্র নেতারা কি দাবি তুলেছেন সেটা আমার জানা নেই। তারা কেউ আমাকে তাদের দাবির বিষয়ে জানানও নি। তবে একজন চাইলেই যে দলের নেতৃত্বে পাবেন সেটা কিভাবে হয়। যার রাজনীতি করেন, যাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, যাকে নেতাকর্মীরা পছন্দ করেন এবং যার নেতৃত্ব মানবেন সেই নেতৃত্বে আসার যোগ্যতা রাখেন।
তিনি বলেন, ‘কমিটি গঠন হবে কিনা সে বিষয়টি আমি নিশ্চিত নই। তবে বিষয়টি নানাভাবে শুনছি। এখনকার কমিটি গঠন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘এখন তো আর কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব বাছাই করা হচ্ছে না। কাউন্সিল করলে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। জনপ্রিয়তা বোঝা যায়। কিন্তু এখন কাউন্সিল হচ্ছে না। তাই সবাই তদবির নিয়ে ব্যস্ত।
তিনি বলেন, ‘কমিটি যে শুধু ছাত্র নেতাদের নিয়েই হতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। আমি শ্রমিক দল করেছি, যুবদল করেছি। এখন মূলদল করছি। তাই ছাত্রদলের বাইরে যুবদল, শ্রমিকদল থেকেও নেতৃত্বে আসতে পারেন। তবে সেটা নির্ভর করবে তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর। একজন নেতা ছাত্র রাজনীতি করে ঘরে বসে থাকবেন, রাজনীতিতে আন্দোলন সংগ্রামে থাকবেন না, আর কমিটি’র সময় আসলেই তিনি পদ চেয়ে বসবেন আর পেয়েও যাবেন সেটা কি করে সম্ভব বলেও প্রশ্ন তোলেন এই নেতা।
এইচেকআর