লকডাউনের একমাসে বরিশালে ৯ খুন


লকডাউন ও বিধিনিষেধের মধ্যেই চলতি মাসে বরিশাল বিভাগে ৯ টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নির্বাচনী প্রতিহিংসা, জমি সংক্রান্ত বিরোধ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব নিয়ে বেশিরভাগ হত্যার ঘটনা ঘটে। তবে এসব ঘটনার বেশিরভাগেরই রহস্য উদঘাটনসহ আসামীদের আটক করেছে পুলিশ।
জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদ পত্রে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৯ মে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া (উত্তর) ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আ. রব ঢালীর বাড়ীতে অনুষ্ঠিত বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের দু নেতার সমর্থকদের ভিতরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সংঘর্ষে স্থনীয় রব ঢালীর বড়ভাই আব্দুস ছাত্তার ঢালী (৫৫) ও প্রতিবেশী সিদ্দিকুর রহমান (২৮) নিহত হয়।
এ ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ জনসহ মোট ১৮ জনকে আটক করেছে মেহেন্দিগঞ্জ থানা পুলিশ। জানা গেছে, মেহেন্দিগঞ্জের পার্শ্ববর্তী হিজলা উপজেলার সীমান্তবর্তী ধূলখোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বেপারি ও ধূলখোলা ইউনিয়ন যুবলীগের আহবায়ক জামাল উদ্দিন ঢালীর মধ্যে দীর্ঘদিন যাবত আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র দ্বন্দ্ব চলে আসছিল।
মেহেন্দিগঞ্জ থানার ওসি মো. আবুল কালাম জানান, নিহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে। এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এর আগে গত ১৭ মে সোমবার রাত ৮টার দিকে রাজাপুর উপজেলার চরহাইলাকাঠি গ্রামে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে আব্দুল হালিম খলিফা (৪৮) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত আব্দুল হালিম খলিফা মঠবাড়ি ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও একই এলাকার মৃত আব্দুল মজিদ খলিফার ছেলে।
এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী সুখী বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতসহ ১৯ জনকে আসামি করে রাতেই মামলা করেন। পুলিশ রাতেই মামলার তিন আসামি মন্টু খলিফা (৪৫) ও তার স্ত্রী শিউলি বেগম এবং সেলিম খান (৬০) নামে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। রাজাপুর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম জানান, কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপর আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
অপরদিকে ঈদের দিন (শুক্রবার) রাত সাড়ে ১১টায় খাওয়া-দাওয়া করে দোকানে যাওয়ার পথে উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের কাটাখালী এ হাকিম মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় স্থানীয় মুদি ব্যবসায়ী মনির শিকদারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১৭ মে রাঙ্গাবালী থানা পুলিশ প্রতিবেশী ব্যবসায়ী জাকির আকনকে সন্দেভাজন গ্রেফতার করলে বেরিয়ে আসে হত্যার রহস্য। পুলিশ জানিয়েছে স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কের জেরে মুদি ব্যবসায়ী মনিরকে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে হত্যা করে জাকির।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গাবালী থানার ওসি (তদন্ত) আবুল খায়ের বলেন, সন্দেহমূলক আটকের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনে গত সোমবার (১৭ মে) সকালে জিজ্ঞাসাবাদের পর থানা হেফাজতে জাকির ঘটনার বর্ণনা এবং কারণ স্বীকার করেন। এ ছাড়া ১২ মে পটুয়াখালীর গলাচিপায় গরু চুরির অভিযোগে আল আমীন সর্দার (২৬) নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
নিহত আল আমীন চর কাজল ইউনিয়নের বড় চর কাজল গ্রামের ওলি সর্দারের ছেলে। গলাচিপা থানার ওসি শওকত আনোয়ার জানান, ঘটনার বিষয়ে তদন্ত চলছে । তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে দোষিদের আইনের আওতায় আনা হবে। গত ২ মে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় হানজালা নামে পাঁচ বছরের এক শিশুকে হত্যার দায়ে বাবা ও সৎমাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, বাবার বিচ্ছেদ হওয়ার পর নানির কাছে বড় হওয়া শিশু হানজালাকে গত ১৪ এপ্রিল বেড়াতে নিয়ে যায় সৎমা শাহানা বেগম। পরে শিশুটিকে অমানসিক নির্যাতন করা হয়। আহত শিশুটিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে বরিশাল পাঠান।শিশুটির বাবা ও সৎমা বরিশাল না নিয়ে গোপনে হাসপাতাল সড়কের মা ও শিশু ক্লিনিকে ভর্তি করেন। ক্লিনিকেও শিশুটির অবস্থার অবনতি ঘটলে পরে সেখান থেকে ১৫ এপ্রিল সকালে শিশু হানজালাকে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত্যু ঘোষণা করেন।
অ্যাম্বুলেন্সে করে শিশুটির মরদেহ গভীর রাতে মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সামনে ফেলে রেখে বাবা ও সৎমা পালিয়ে যান। নিহতের নানী মামলা করলে পুলিশ সৎমাসহ তিনজনকে আটক করে রিমান্ড শেষে তাদের কারাগারে প্রেরণ করেন। এদিকে ১৮ মে মঙ্গলবার গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের কমলাপুর গ্রামে ভিজিডি কার্ডের মালামাল নিয়ে বিরোধের জেরধরে চাচার হামলায় ভাতিজা নিহত হন। নিহত রামিন মৃধা (২১) ওই গ্রামের সান্টু মৃধার পুত্র।
এ ঘটনায় পরের দিন বুধবার সকালে থানায় হত্যা মামলা দায়েরের পর পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করে। গৌরনদী মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মোঃ তৌহিদুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় নিহতের দাদা মোঃ চেয়ারআলী মৃধা বাদি হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। তাৎক্ষনিক পুলিশ অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত আসামি তোফাজ্জেল মৃধাকে গ্রেফতার করেছে। তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
অন্যদিকে ১৬ মে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী লোন্দা গ্রামে যৌতুক না পেয়ে স্ত্রী রূবিনা আক্তার (২২) কে হত্যা করে স্বামী। নিহত রুবিনা পাশ্ববর্তী চম্পাপুর ইউনিয়নের পাটুয়া গ্রামের রফিক হাওলাদারের মেয়ে। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে স্বামী শিমুল খলিফাকে গ্রেফতার করে।
এদিকে বামনা উপজেলার ডৌয়াতলা ইউনিয়নের হলতা ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজের কোষাধ্যক্ষ মো. গোলাম মোস্তফাকে নৃসংশভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। তিনদিন নিখোঁজ থাকার পর ডৌয়াতলা গ্রামের সরকার বাড়ির একটি খাল থেকে শুক্রবার (২১ মে) সকাল ৬টায় তার মরদেহ উদ্ধার করে বামনা থানা পুলিশ। নিহতের শরীরে ৯টি ধারালো দায়ের কোপের চিহ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ ঘটনায় দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। তারা হলেন নিহতের ভাগিনা একই গ্রামের জব্বার আলী হাওলাদারের ছেলে মো. মিজানুর রহমান (৪০) ও মতি সরকারের ছেলে মো. নাসির (৩৫)। বামনা থানার ওসি তদন্ত মো. আবুল হোসেন শরিফ জানান, লাশের সুরতহাল রিপোর্ট সংগ্রহ করার সময় শরীরে প্রায় ৯টি ধারালো দায়ের কোপের চিহ্ন রয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে গত বুধবার রাতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ৫ এপ্রিল ভোর থেকে সারাদেশে প্রথম দফায় এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয়। এর আগে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাইকে চলাচলের নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এপ্রিল মাসজুড়েই ছিল কড়াকড়ি। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হয়। পরে ২১ থেকে ২৮ এপ্রিল, ২৯ থেকে ৫ মে এবং ৬ মে থেকে ১৬ মে পরবর্তিতে ২৮ মে পর্যন্ত লকডাউন বাড়ানো হয়। এ সমযের ভিতরে এ হত্যা কান্ডের ঘটনাগুলো ঘটেছে ।
এমবি
