প্রজ্ঞাবান মানুষের মৃত্যু ক্ষণকালের হলেও এঁরা বেঁচে থাকেন অনন্তকাল


বেগম সাহান আরা আবদুল্লাহ ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ জননী। তিনি ছিলেন, একজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজসেবক, ছিলেন তুখোড় রাজনীতিবিদ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াল কালরাতের প্রত্যক্ষদর্শী ও সন্তান হারানো বেদনাময়ী মা ছিলেন তিনি।
ছিলেন কালউত্তীর্ণ রাজনৈতিক নেতা শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আপন ফুফাতো ভাইয়ের স্ত্রী। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক, সাবেক চিফ হুইপ ও বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর একান্ত সহধর্মিণী এবং বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর রত্নগর্ভিণী মা।
তিনি ছিলেন, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। এছাড়াও, বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সর্বোত্তম আপনজন। বরিশাল শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারের আজীবন চেয়ারম্যান, মাসিক আনন্দলিখন পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন তিনি। এ জন্যেই বিশিষ্ট সমাজসেবক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল।
ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন সাহান আরা আবদুল্লাহ। ছিলেন তৎকালীন বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি। তাই তো, আমৃত্যু তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।
স্বাধীনতা স্বার্ভভৌমত্বের পর বাঙালি জাতির সব থেকে কলঙ্কময় অধ্যায় ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি। যেহেতু সাহান আরা আবদুল্লাহ সেই ১৫ আগস্ট কালরাতের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। আর সে কারণেই সেদিন তিনি ঘাতকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন।
সেদিনের নির্মম হত্যাকাণ্ড চালাকালীন সময় তাঁর শরীরে ঘাতকের বন্ধুকের তিনটি গুলি লেগেছিল, যে বুলেটবিদ্ধ ক্ষত-বিক্ষত যন্ত্রণা মৃত্যু-অবধি তিনি শরীরে বহন করে চলেছিলেন। ঘাতকদের গুলিতে সেদিন তাঁর প্রথম শিশু সান্তান সুকান্ত বাবু চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেও, নীরবে সেই দৃশ্যও দেখতে হয়েছে তাঁকে।
একইভাবে সেদিন কোলে থাকা আজকের বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেইরাতে সাহান আরা আবদুল্লাহর শরীরে গুলি লাগার পর তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার কারণেই হত্যাকারীরা মৃত ভেবে তাঁকে ফেলে রেখে গিয়েছিল।
এমনিভাবেই সেদিন সকলের দোয়ায় তিনি ও তাঁর দি¦তীয় সন্তান আজকের যুবরত্ন সাদিক আবদুল্লাহ বেঁচে গিয়েছিলেন।
সাহান আরা আবদুল্লাহ ছিলেন বরাবরই উদার, আন্তরিক ও খোলামেলা মনের মানুষ। গত বছরের ৭ জুন (২০২০) আজকের দিনে তিনি তাঁর পরিবার, রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠজনদের এবং আরও অনেক শুভাকাঙ্খীকে কাঁদিয়ে অনন্তের পথে চলে গেছেন।
এরপরও সত্যি-সত্যিই যদি বলতে হয়, হঠাৎই বরিশালবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেছেন মহীয়সী গর্বিণী এই নারী। রাজনৈতিক পরিবারের পুত্রবধূ হিসেবে শ্বশুর-স্বামীর রাজনৈতিক সাহচার্যে তিনি নিজেও হয়ে উঠেছিলেন তুখোড় রাজনীতিবিদ, তা-না হলে, কেনই বা এতো মানুষ তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন?
পারিবারিক দৃষ্টান্ত ও সঞ্চালক হিসেবেও তিনি সফল মাতৃত্বের অধিকারিণী ছিলেন, না হলে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে সন্তানকে তিনি এতোটাই জনপ্রিয় ও যোগ্য নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে দিতে পারতেন না কিছুতেই। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে তাঁর অন্য দুই সন্তানের সাফল্যও মাতৃ-দূরদর্শিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও বটে।
তবুও বলা যায়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সীমানা ছাড়িয়েও আরও অনেক গুণ তো এই মানুষটির ছিলই! যা তাঁকে জীবিত অবস্থাতেই পরিণত করেছিল অনন্য এক কিংবদন্তিতে।
যদিও অনন্তের পথে চলে যাওয়াটা সব সময়েই দু:খের কিন্তু এমন একজন গুণীন এবং প্রজ্ঞাবান মানুষের মৃত্যু নিশ্চয়ই তাঁর আত্মজন, আপনজন এবং শুভাকাঙ্খীদের জন্য অনেক অনেক বেশি দু:খের।
তাই, আজ বেগম সাহান আরা আবদুল্লাহর মৃত্যুদিন হলেও, এমন প্রজ্ঞাবান মানুষের মৃত্যু হয় ক্ষণকালের জন্য কিন্তু অগণিত মানুষের মনে এঁরা বেঁচে থাকেন অনন্তকাল।
## লেখক : কবি ও দৈনিক মতবাদের যুগ্ম সম্পাদক।
এমবি
