লাইনম্যানের মৃত্যু : ক্ষতিপূরণে দায় এড়ানোর চেষ্টা


বরিশালে বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুতের পোলে উঠে লাইনম্যানের পুড়ে মৃত্যুর ঘটনায় এক উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি এই ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সোমবার সকালে তিন সদস্যের ওই কমিটি বরিশাল সার্কিট হাউজে এসে তাদের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
তবে অভিযোগ উঠেছে তদন্ত শুরুর আগেই ক্ষতিপূরণ বাবদ ছয় লক্ষ টাকায় লাইনম্যানের মৃত্যুর ঘটনার দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ্রই মধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং বিদ্যুৎ বিভাগের শ্রমিক নেতাদের মধ্যস্ততায় বিষয়টি রফাদফা হয়েছে। যার দরুণ ময়না তদন্ত ছাড়াই সোমবার সন্ধ্যায় ওই শ্রমিকের লাশ দাফন করেছেন তার স্বজনরা।
এর আগে গত শনিবার বিকালে বরিশাল নগরীর রূপাতলী ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ও.জো.পা.ডি.কো) বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রে’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কার্যালয়ের অভ্যন্তরে মই বেয়ে পোলে উঠে বিদ্যুত লাইনের কাজ করছিলেন চুক্তিভিত্তিক লাইনম্যান ফয়সাল। লাইন মেরামত শেষ হওয়ার আগেই বিদ্যুৎ সংযোগ দিলে পোলে বিদ্যুতের তারে ঝুলে প্রথমে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট এবং পরে পুড়ে মৃত্যু হয় ফয়সালের। এসময় আরও একজন আহত হন। নিহত ফয়সাল বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলি গ্রামের বাসিন্দা সিকিম আলী হাওলাদারের ছেলে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ‘ও.জো.পা.ডি.কো’র অভ্যন্তরে চারজন ঠিকাদাররের বিদ্যুৎ সংযোগ মেরামত বা সংস্কার কাজ চলছে। এর মধ্যে মিজান নামক ঠিকাদারের হয়ে দৈনিক মজুরিতে কাজ করে আসছিলেন ফয়সাল। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত উপ-সহকারী প্রকৌশলী, ফিডার ইনচার্জ ও সুপারভাইজারের দায়িত্ব অবহেলার কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।
বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্র-১ এর নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ‘ওই ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অপরাধে শহিদুল ইসলাম নামের একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে ছয় মাসের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনার তদন্তে ঢাকা থেকে উচ্চ পর্যায়ের তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা সোমবার বরিশালে এসে সার্কিট হাউজে অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি সোমবার থেকেই তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
অপরদিকে, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের কয়েকটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ‘অবহেলায় মৃত্যুর ঘটনাটি ছয় লক্ষ টাকায় ধামা চাপা দেয়ার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এরি মধ্যে নিহতের স্বজনদের সাথে এ বিষয়ে চুক্তি সম্পন্ন করেছেন তারা। চুক্তি অনুযায়ী ঘটনার দুদিন পরে অর্থাৎ সোমবার সন্ধ্যায় ময়না তদন্ত ছাড়াই নিজ এলাকা তলতলি ভেদিবাড়ি পারিবারিক গোরস্থানে নিহত ফয়সালের মৃতদেহ দাফন করেছেন তার স্বজনরা।
নিহত’র ভাই আব্দুস জলিল ও ভাতিজা সবুজ জানিয়েছেন, ‘ঘটনাটি নিয়ে আমরা কোন মামলায় জড়াতে চাচ্ছি না। কেননা ফয়সালের পরিবার নিতান্তই গরিব। তার একটি সন্তান এবং অন্তসত্ত্বা স্ত্রী রয়েছেন। তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বিদ্যুৎ বিভাগের সমঝোতার প্রস্তাবি আমরা রাজি হয়েছি। তাছাড়া নিহতের ঘটনায় তার পরিবার আইনী জটিতলায় জড়াতে চাচ্ছে না।
তারা আরও বলেন, ‘ফয়সালের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে ১৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের দাবি করেছিলাম। এর মধ্যস্ততা করেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু ও চরবাড়িয়ার ইউপি চেয়ারম্যান মাহাতাব হোসেন সুরুজ। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ তা না মানায় পরে ১০ লক্ষ এবং সবশেষ ৭ লক্ষ টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু তাতেও রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ৬ লক্ষ টাকা দাবি করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সেটাই মেনে নিয়েছে। তবে ক্ষতিপূরণের ওই টাকা এখনো নিহতের স্বজনদের হাতে এসে পৌঁছেনি।
তবে সমঝোতা কিংবা ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন চরবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহাতাব হোসেন সুরুজ। অবশ্য সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘পরিবারটা অসহায়। মামলা চালাতে গেলে খরচের প্রয়োজন আছে। আবার বিচার পেতেও সময়ের প্রয়োজন। তার থেকে কিছু টাকা হলে পরিবারটি কিছু করে খেতে পারবে। এ কারণেই বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে কিছু ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কি-না সেটার চেষ্টা করা হয়েছে। ফয়সালের দাফন কাফনের পরে বিষয়টি আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান করা হবে।
এদিকে, ‘উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত এবং তদন্তসহ সার্বিক বিষয়ে তথ্য জানতে চাইলে ও.জো.পা.ডি.কো’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অমূল্য কুমার সাহা কোন প্রকার তথ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে সাংবাদিকদের তথ্য দিতে নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া এটি এখন তদন্তাধীন রয়েছে। তাই এ নিয়ে কিছু বলা যাবে না। অবশ্য উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বরখাস্ত হওয়া উপ-সহকারী প্রকৌশলী (এসও) শহিদুল ইসলাম এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তার মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম মৃতদেহের ময়না তদন্ত করতে। কিন্তু নিহতের স্বজনরা এই ঘটনায় কোন মামলা করবে না বিধায় ময়না তদন্ত করতে রাজি হয়নি। তারা বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার স্যারের কাছে গিয়ে ময়না তদন্ত ছাড়া লাশ গ্রহণের দাবি জানান। কমিশনার স্যারের নির্দেশে অপমৃত্যু মামলা করে মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে মামলা করতে চাইলে সেটা গ্রহণ করা হবে বলেও জানিয়েছেন ওসি।
এমবি
