ইউপি নির্বাচন : বরিশালে নৌকা ডুবাতে প্রস্তুত আওয়ামী লীগ


আগামী ২১ জুন প্রথম ধাপে সারাদেশের ন্যায় বরিশাল বিভাগের ৩৩টি উপজেলার মোট ১৭৩ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় নির্বাচন হবে ৯টি উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নে।
রাজনৈতিক কারণে এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি বিএনপি। তাই প্রার্থী সংকটে বিভাগের ১৭৩টি ইউনিয়নের ২৬ টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭ ইউপি চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে।
এসব ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ মনোনিত প্রার্থীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তবে ভোটের লড়াই আওয়ামীলীগ এবং স্বতন্ত্র অর্থাৎ নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে হবে বলে ধারণা স্থানীয়দের। এমনকি নিরপেক্ষ নির্বাচনে অধিকাংশ ইউনিয়নে বিদ্রোহীদের দাপটে নৌকার ভরাডুবির আশঙ্কাও করছেন অনেকে।
এ কারণেই বরিশালসহ বিভাগের সকল ইউনিয়নে বিদ্রোহী দমাতে শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এমনকি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ তাদের অনুসারীদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হচ্ছে।
এরইমধ্যে শনিবার বিকালে এক দিনেই বরিশাল জেলার ৯টি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ১৯ জন বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীকে তাদের স্ব স্ব পদ থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ। এর পরেও বিদ্রোহীরা নির্বাচন থেকে সরে না যাওয়ায় নির্বাচনের দিনে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘প্রথম ধাপে বরিশাল বিভাগের ১৭৩ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৬৯৫ জন। এছাড়া সাধারণ ওয়ার্ডে মোর্ট পাঁচ হাজার ৯৩১ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডে এক হাজার ৮২৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এদের মধ্যে ২৬টি ইউনিয়নে ২৬ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যার মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল জেলার ৫টি উপজেলায় ১৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া ইউনিয়নগুলো হলো- বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুধল, বানারীপাড়া উপজেলার উদয়কাঠী, বিশারকান্দি, ইলুহার, বানারীপাড়া, সলিয়াবাকপুর, উজিরপুর উপজেলার শোলক, গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর, বাটাজোড়, বার্থী, মাহিলাড়া, চাঁদশী, নলচিড়া এবং মুলাদী উপজেলা সদর ইউনিয়ন।
এছাড়া বিভাগে সংরক্ষিত ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এক হাজার ৮২৭ জন। যার মধ্যে ৭ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং সাধারণ ওয়ার্ডে ৫ হাজার ৯৩১ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ৩১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে।
অপরদিকে, ‘কেন্দ্রের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বরিশাল বিভাগের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে নিজ দলের মনোনিত প্রার্থীর নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। তাদের অভিযোগ প্রার্থী মনোনয়নে অনিয়ম এবং ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় দলীয়ভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে বাধা নেই বলেও দাবি তাদের। তাছাড়া অধিকাংশ ইউনিয়নে সুষ্ঠু নির্বাচনে বিদ্রোহীরা বিজয়ের বিষয়েও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।
আলাপকালে উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী উর্মিলা বাড়ৈ বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হলেও দলের মধ্যে থেকে চাইলে অন্য কেউ নির্বাচন করতে পারবেন। যার জনপ্রিয়তা আছে তাকেই জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন।
তিনি বলেন, ‘ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া বর্তমান চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদার একজন দুর্নীতিগ্রস্ত চেয়ারম্যান। ইতিপূর্বে এর প্রমাণ জনগণ পেয়েছে। তার পরেও আলোচিত এই নারীকে পুনরায় দলীয় মনোনয়ন দেয়ায় ভোটাররা তাকে মেনে নিতে পারেননি। তাই জনগণের দাবি পূরণ করতেই ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বরিশাল জেলা পরিষদের সাবেক এই সদস্য। তিনি বলেন, জনগণের দাবি পূরণ করতেই জেলা পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে আমি ইউপি চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছি।
অপরদিকে, বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম ওরফে ইতালি শহীদ। এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করছেন বর্তমান চেয়ারম্যান মাহাতাব হোসেন সুরুজ। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে এরই মধ্যে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার হয়েছেন শহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘দলীয়ভাবে প্রার্থী বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে। এ কারণেই জনগণের কথায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। তবে আমি নৌকার বিরুদ্ধে নয়, ভুল লোকের হাত থেকে নৌকাকে রক্ষা করতেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছি। সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ের ‘ভি’ চিহ্ন তিনিই তুলবেন বলে দাবি তার।
এদিকে, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তারা আওয়ামী লীগের লোক হতে পারেন না বলে দাবি করেছেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস। তিনি বলেছেন, কিছু কিছু ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নৌকার বিপক্ষে স্থানীয় এমপি এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ইন্ধন রয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের ভালো চায়না বলেই বিদ্রোহী দাঁড় করিয়েছি। এজন্য তারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাছাড়া নির্বাচনে জনগণ নৌকাকেই বেছে নিবে বলে আশাবাদী তিনি।
অপরদিকে, বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি এস.এম আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচনে প্রার্থী যে দলেরই হোক আমরা সবাইকেই সমান সুযোগ দিতে চাই। ভোট সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ করতে আমরা সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। বিভাগের ৩৩ উপজেলার মোট ১৭৩ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের পাশাপাশি ভোটারদের নিরাপত্তা এবং শান্তিপূর্ণ ভোট উৎসব সম্পন্ন করতে ১২ হাজার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। কোনভাবেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি এস.এম আক্তারুজ্জামান।
উল্লেখ্য, বরিশাল বিভাগের ১৭৩টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৮ লক্ষ ৯৮ হাজার ৮৬৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ ১৪ লক্ষ ৬৮ হাজার ৮৪৪ এবং নারী ভোটার ১৪ লক্ষ ৩০ হাজার ২৫ জন। তাদের ভোট গ্রহণে স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলিয়ে মোট এক হাজার ৬৪৩টি ভোট কেন্দ্র এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ৮ হাজার ৯৫৬ টি। এর মধ্যে অস্থায়ী ভোট কক্ষের সংখ্যা ৪১০টি। ভোট কেন্দ্রে মোট প্রিজাইডিং অফিসারের সংখ্যা একহাজার ৬৩৩ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার থাকবেন ৮ হাজার ৫৪৬ জন এবং সহকারী পোলিং অফিসার থাকবেন ১৭ হাজার ৯২ জন।
এছাড়া অতিরিক্ত ৮২ জন প্রিজাইডিং, ৪২৭ জন সহকারী প্রিজাইডিং, ৮৫৫ জন পোলিং অফিসার থাকবেন।
এমবি
