বহুল আলোচিত উদীচী বোমা হামলার ২৫ বছর আজ


বহুল আলোচিত উদীচী বোমা হামলার ২৫ বছর পূর্তি হলেও এখনো হামলাকারীদের শনাক্ত এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। মামলাটি পুনরায় চালুর জন্য উচ্চ আদালতের একটি আদেশের জন্য এক যুগ ধরে অপক্ষো করছেন ওই ঘটনায় আহত ও নিহতদের পরিবারসহ যশোরবাসী। হত্যার বিচার না পেয়ে আজও স্বজনরা কাঁদছেন নীরবে।
যশোরে উদীচী ট্র্যাজেডির ২৫ বছরেরও বিচার না পেয়ে স্মৃতিস্তম্ভে এসে কাঁদছেন নিহত তপনের বোন বিউটি আক্তার।
বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি কলঙ্কিত দিন ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ। এদিন যশোর টাউন হল ময়দানে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে বর্বর বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন। আজ বুধবার দুই যুগ পার হয়ে গেল, এখনো পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বিচার হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের অভিযোগ, রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলার কারণেই বিচার পাচ্ছেন না তারা।
মার্চ মাস এলেই প্রিয় ভাই তপনসহ ১০ সাংস্কৃতিক কর্মীর স্মৃতিতে তৈরি এই স্তম্ভে এসে সময় কাটান বিউটি আক্তার। অজান্তে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে বেদনার অশ্রু। একবুক হতাশা নিয়ে বিলাপ করেন তিনি। ভাই হারানোর বেদনার থেকে, ২৫ বছরেও বিচার না পাওয়ার কষ্টটাই যেন বেশি ছিল। তবে এখনও তিনি ন্যায় বিচার পাওয়ার আশা রাখেন।
উদীচী হামলায় নিহত তপনের বড় বোন নাজমুন সুলতানা বিউটি বলেন, ‘ আজ ২৫ বছর হয়েছে ভাইকে হারিয়েছি। সারা বছরই কষ্ট। কিন্তু মার্চ মাস আসলেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। আমার মা শয্যাশায়ী। আমার মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও এই হত্যার বিচার দেখতে চাই। প্রত্যেক বছর সাংবাদিকরা এই বিষয়টা সামনে নিয়ে আসেন। সবাই এই বিচারের আশায় আছে। কিন্তু জেগে ঘুমায় থাকলে সেই ঘুম ভাঙানো যায় না। আমরা চাই আমার ভাই হত্যার বিচার হোক। রাষ্ট্রের কাছে এই একটাই আবেদন।’
বোমা হামলায় পা হারানো সুকান্ত দাস বলেন, ‘দীর্ঘ ২৫ বছর হয়ে গেল অথচ এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার হলো না; এটা বলতেও এখন আমাদের লজ্জা লাগে। ১৯৯৯ সালে যখন ঘটনা ঘটেছিলো তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিলো। এখনো এই সরকার ক্ষমতায়। তারপরও এই ঘটনার বিচার হলো না, কী বলবো? নিজেদের কাছে আশ্চর্য মনে হয়।’
তিনি দাবি করে বলেন, গত ২০/২৫ বছরে বাংলাদেশে বহু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। উদীচীর মতো একটা বড় হত্যাকাণ্ড, যেটা জাতীয় পর্যায়ের, এর বিচার না হওয়ায় সরকারের দায় আছে। আমরা মনে করি রাষ্ট্র যদি চায় এখনই এর বিচার সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, ‘উদীচীর ঘটনায় পা হারিয়ে নানাবিধ কষ্টের মধ্যে আছি। এর মধ্যে বড় ব্যথা বিচার না পাওয়ার। ন্যায় বিচারটা পেলে দোষীদের দণ্ডিত হতে দেখতে পারলে সব কষ্ট ম্লান হয়ে যেত।’
উদীচী যশোরের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব বলেন, ‘আমাদের আক্ষেপ যে ২৫ বছর ধরে আমাদের বিচার চাইতে হচ্ছে। ২০০৬ সালে এই মামলার প্রথম রায়ে সব আসামিকে খালাস দেয়া হয়। সেখানে বিচারক দুর্বল তদন্তের বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। ন্যায় বিচার পেতে আমরা আপিল ও পুনঃতদন্তের আবেদন করি। সেটাও ১৮ বছর হয়ে গেছে। দীর্ঘ এই সময়েও একটা তদন্ত পেলাম না। বর্তমান প্রজন্ম উদীচী ট্রাজেডির কথা জানেই না। ফলে এর বিচার নিয়ে আমাদের মধ্যে সংশয় রয়েই গেছে। তবে আমরা চাই এই সরকার একটি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ন্যক্কারজনক এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি কলঙ্কিত দিন ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ। এদিন যশোর টাউন হল ময়দানে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে বর্বর বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন। আজকে দুই যুগ পার হয়ে গেল, এখনো পর্যন্ত আমরা এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বিচার পেলাম না। প্রকৃত দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা হলো না।
তিনি বলেন, ‘রাজনীতিকরণ করার মধ্য দিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করে এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত যারা দোষী অপরাধী তারা পার পেয়ে গেল। এটা আমাদের জন্য, জাতির জন্য একটি দুঃখজনক এবং কলঙ্কজনক বিষয়। ইতিহাস এ বিষয়টিকে কখনো ক্ষমা করবে না। একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে আমরা বিস্মিত , দুঃখিত, লজ্জিত, যে আজকে দুই যুগ পরেও সেই হত্যাকাণ্ডের আমরা সুষ্ঠু বিচার পেলাম না।’
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ইদ্রিস আলীর দাবি, এ মামলার আপিল শুনানির জন্য তদবির প্রয়োজন। শুনানি সম্পন্ন হলে মামলাটি গতি পাবে এবং দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে।
এ দিকে দিবসটি উপলক্ষে আজ বুধবার (৬ মার্চ) দুপুরে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান, বিকেলে মৌন মিছিল, আলোচনা সভা, শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও মশাল প্রজ্বলন এবং প্রতিবাদে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে উদীচী যশোর।
জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ রাতে যশোরে এ টাউন হল মাঠে উদীচীর দ্বাদশ মহাসম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় নিহত হন ১০ সাংস্কৃতিক কর্মী। অঙ্গহানি ঘটেছে সুকান্ত, নাহিদসহ কয়েকজনের। আর বোমার স্প্রিন্টারের আঘাতে আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ; যার দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। কিন্তু দুর্বল তদন্তের কারণে বিভীষিকাময় ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০০৬ সালের ৩০ মে খালাস পেয়ে যায় সব আসামি।
এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে উদীচী ও ২০১১ সালে সরকার হাইকোর্টে আপীল করলে তা গৃহীত হয়। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৭ আসামি আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।
মামলাটি পুনরায় চালুর জন্য উচ্চ আদালতের একটি শুনানি ও আদেশের প্রয়োজন। কিন্তু এক যুগ ধরে সেই শুনানি হয়ে ওঠেনি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিচার না পেয়ে হতাশ ক্ষতিগ্রস্ত ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। তাদের অভিযোগ রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলার কারণেই বিচার পাচ্ছেন না তারা।
এমএন
