প্রধানমন্ত্রীর কাছে বুয়েট শিক্ষার্থীদের খোলা চিঠি


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আমরা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত পাঁচ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী আপনার প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখে সবিনয়ে আমাদের দু-চারটি কথা এবং আর্জি আপনার কাছে নিবেদন করছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের স্বপ্নসারথি, বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুসরণ করে আপনি দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলেছেন। আপনি দেশকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এগিয়ে যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, সেই একই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে নিজেদের শ্রম-মেধা-মনন কাজে লাগিয়ে নিরঙ্কুশ অধ্যবসায়ের পর আপনার গর্বের এই দেশসেরা প্রতিষ্ঠানে আমরা পড়ার সুযোগ করে নিয়েছি।
আমরা করোনার সেই বিপদ মুহূর্তে বানিয়েছি লো কষ্ট ভ্যান্টিলেটর, ক্লিন সিটির আশায় পরিত্যক্ত মাস্ক থেকে বানাচ্ছি কনক্রিট, আরও খুঁজছি বিদ্যুতের সহজ উপায়, বানাচ্ছি আর্টিফিশিয়াল আর্মস, সার্জিক্যাল টুলস, পদ্মা সেতু নির্মাণে আমাদের শিক্ষক এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের অবদান অনবদ্য।
রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরবেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা
শুধু দেশেই না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্য দেশের দলগুলো—যাদের জন্য বরাদ্দ থাকে আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ এবং গবেষণাগারের সুবিধা—তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা ছিনিয়ে আনছি বিজয়। আপনি নিঃশর্তভাবে আমাদের অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন এসব গবেষণা খাতে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের অভিভাবক। আমরা নিজেদের মেধা ও শ্রমের সবটুকু দিয়ে বিজ্ঞানের অবাক করা দুনিয়ার একটা অংশের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে দেখতে চাই। আমরা ত্রাসের রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না। আমরা শুধু দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে জানি। নিজেদের কাজ দিয়ে তা আমরা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি মানবকল্যাণব্রতী। আপনি আমাদের সবার অভিভাবক, দেশের অভিভাবক। আমরা জানি দেশের কোথাও কোনো দুঃখজনক পরিস্থিতি চললে, দেশের কোথাও সংকট চললে, আপনার হৃদয়ে গভীর রক্তক্ষরণ হয়।
ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সূচনা ঘটেছে আধিপত্য, দাপট, র্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন, খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মতো ঘটনা এবং এর ব্যাপ্তি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এর চরমতম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল ৯৯ এর সাবেকুন্নাহার সনি আপু, যন্ত্রকৌশল ০৯ এর আরিফ রায়হান দ্বীপ ভাই এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল ১৭ এর আবরার ফাহাদ ভাইকে হারিয়েছি।
শুধুমাত্র আবরার ফাহাদ ভাইয়ের হত্যাকাÐই নয়, এর আগেও অসংখ্য শিক্ষার্থীকে র্যাগিংয়ের দ্বারা কিংবা ছাত্ররাজনৈতিক দাপটের দ্বারা অমানুষিকভাবে নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা রয়েছে, যা আমাদের বুয়েটের র্যাগিং স্টোরি আর্কাইভে সারি সারি আকারে লিপিবদ্ধ আছে।
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার শাহরিয়ারকে স্ট্যাম্প দিয়ে রাতভর বেধড়ক মারধর করা হয়। ১৭ ব্যাচের মেহজাদ গালিবকে নগ্ন করে সোহরাওয়ার্দী হলের ছাদে তুলে স্ট্যাম্প দিয়ে সারারাত মারা হয়। ১৫ ব্যাচের সামিউত তৌসিফকে মেরে হাত-পা ভেঙে দেয়। মারতে মারতে তিনটা স্ট্যাম্প ভেঙে ফেলা হয়। সামিউত তৌসিফ ছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, তার চাচা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। তার লিগামেন্ট ছিঁড়ে পায়ে ফ্র্যাকচার হয়ে যায়।
সালাম না দেওয়ায় সাখাওয়াত অভির হাত ভেঙে ফেলে আবরার ফাহাদের হত্যাকারী অমিত সাহা। সৌমিত্র লাহিড়ী থাপ্পর দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলে একজনের। এরকম আছে আরও অসংখ্য কাহিনী।
দাপটের আড়ালে ছাত্ররাজনীতি আমাদের ক্যাম্পাসে উন্মুক্তভাবে বিচরণের অধিকার, ক্যাম্পাসের সুস্থ একাডেমিক পরিবেশ, আমাদের স্বাধীনতা, হলের মেসের টাকার সৎ ব্যবহার, ক্যাম্পাস মাদকমুক্ত থাকা, নবীন আগত বুয়েটিয়ানদের একটি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন উপভোগের অধিকার—সবকিছুই হারিয়ে গিয়েছিল। ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব। মৌলবাদী শক্তিকেও রুখে দিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ।
বুয়েট শিক্ষার্থীরা বরাবরই একটি নিরাপদ এবং সুস্থ ক্যাম্পাস চেয়ে এসেছে, যেখানে ক্ষমতা-চর্চার লোভ-লালসার শিকলে আবারও জিম্মি হয়ে যাবে না সবার নিরাপত্তা, শিক্ষাঙ্গনের উপযুক্ত পরিবেশ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জেনে খুশি হবেন যে বাকি সব প্রকৌশল-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বুয়েটেও থিসিসের জন্য রিসার্চ টাস্ক চতুর্থ বর্ষে আবশ্যক হলেও আমাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা আগে থেকে বিভিন্ন রিসার্চ প্রজেক্টে নিজ ইচ্ছায় অংশগ্রহণ করছে।
এ ছাড়া, দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রকৌশল প্রতিযোগিতায়, বিতর্ক প্রতিযোগিতায়, কুইজ প্রতিযোগিতায়, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বুয়েটিয়ানদের সাফল্য গত সাড়ে চার বছরে সুস্পষ্টভাবে বেড়েছে।
আপনি জেনে আরও খুশি হবেন যে তথ্য-প্রযুক্তিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় আমাদের অর্জন স্বর্ণপদক। ইয়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সাইন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ডের মতো বিশ্ব সমাদৃত অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বুয়েটের ছয় জন এবং শুধু গত বছরেই চার শিক্ষার্থী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন যে বুয়েটের প্রকৃতি ভিন্ন। তাই তিনি নিজে রাজনীতির আওতা থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাইরে রেখেছিলেন। আজ যখন তারই গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বুয়েটের মতো বিশেষায়িত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যেকোনো মূল্যে রাজনীতির আওতায় আনার কথা বলে, আমরা বিশ্বাস করি তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও সিদ্ধান্তকে অপমান করা হয়।
একইসঙ্গে সিনিয়র-জুনিয়র কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামিয়েছে বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ফেস্ট, ডিপার্টমেন্টাল ডে—যেখানে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা আমাদের সহপাঠীরাও যথেষ্ট খুশি হয়েছে আমাদের আয়োজনে।
এ আয়োজন ও অংশগ্রহণ সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র একটি নিরাপদ ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের কারণে। যেখানে হল রেসিডেন্ট কোনো শিক্ষার্থীকে চিন্তায় থাকতে হয়নি যে হলে তাকে র্যাগের সম্মুখীন হতে হবে বা এটাচড কোনো শিক্ষার্থীরও উদ্বেগ ছিল না যে ক্যাম্পাসে আসলে তাকে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে।
আমরা বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয় মূল্যবোধ, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ আমাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য এবং একান্ত পালনীয়। আমরা সাংগঠনিক রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এসেই এই সচেতনতা রাখি।
অথচ, অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে কতিপয় ব্যক্তি বা গণমাধ্যমের তৎপরতায় ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েট ক্যাম্পাসকে জাতীয় চেতনার বিরোধী মতাদর্শের স্থান হিসেবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিষয়টিতে আমরা অত্যন্ত ব্যথিত।
আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের ব্যাপারে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। তাই দেশের যেকোনো স্থানের মতো আমাদের ক্যাম্পাসকে আমরা অবশ্যই যেকোনো প্রকারের সন্ত্রাস, মৌলবাদ বা নিষিদ্ধ গোষ্ঠী থেকে নিরাপদ রাখতে সর্বদা তৎপর।
বুয়েট ক্যাম্পাসে এই চার বছর আমরা নির্বিঘেœ কাটিয়েছি, সেখানে ছায়া হয়ে ছিলেন আমাদের শিক্ষকরা। আমাদের মতো দেশ জুড়ে লাখো শিক্ষার্থী এমন একটা ক্যাম্পাসের স্বপ্ন নিয়েই বাড়ি ছাড়ে, যেখানে তাদের ওপর অকারণে জুলুম হবে না, নির্যাতিত হতে হবে না, দিন রাত কারো ভয়ে তটস্থ থাকতে হবে না, বাবা-মাকে দুশ্চিন্তায় চোখের পানি ফেলতে হবে না।
আমরা, আমাদের ছোট ভাই-বোনেরা আরও একবার সেই অন্ধকার দিনগুলোর সাক্ষী হতে চাই না। মাননীয় উপাচার্য এবং সব শিক্ষকের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা জানি তারা তাদের সন্তানদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় সর্বদা সচেষ্ট আছেন এবং থাকবেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে সবিনয়ে অনুরোধ, আপনি আমাদের পাশে দাঁড়ান। আপনি সব সময় শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন। আমরা জানি, এই দুর্দিনে আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।
(সংক্ষেপিত)
এমএন
