পিরোজপুরে ভাঙা বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্ক, ঘরবাড়ি হারানোর শঙ্কায় ২০ হাজার মানুষ


পিরোজপুর সদর উপজেলার কলাখালি ইউনিয়নের কৈবর্তখালি গ্রামের শিমুল শেখ। স্ত্রী সালমা আক্তার ও দুই সন্তান নিয়ে কঁচা নদীর ভাঙা বেড়িবাঁধের পাড়ে কাঁচা মাটির ছোট একটি ঘরে তার বসবাস।
তাদের ঘরটি ভাঙা বেরিবাধের পাড়েই হওয়ায় বর্ষা মৌসুম এলেই সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় কখন নদী গর্ভে বিলীন হবে তাদের ঘরটি। এসব কথা চিন্তা করলেই মুখ মলিন হয়ে যায় তার। শুধু শিমুল শেখ নয় পিরোজপুরে নদী তীরের ২০ হাজার মানুষের দুশ্চিন্তা এমনই।
বুধবার কথা হয় শিমুল শেখের সাথে তিনি বলেন, বর্ষা এলেই আমাদের বেড়িবাঁধটি ভাঙা শুরু হয়। ভাঙতে ভাঙতে এখন প্রায় শেষ হয়ে গেছে। নদীভাঙনে এখন সবসময় ভিটেমাটিসহ জমিজমা হারানোর ভয়ে থাকি। বেড়িবাঁধটি আবার পুননির্মাণ করার দাবি আমাদের।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে শিমুল শেখের স্ত্রী সালমা আক্তার বলেন, বর্ষাকাল এলেই বুক কাঁপতে থাকে কখন কি হয়। তারপরে আবার বেড়িবাঁধ ভাঙা থাকায় অনেক বিপদের মধ্যে থাকি।
জোয়ার বেশি হলেই নদীর পানি সব ঘরে ওঠে, ঘরের আশপাশ সব পানিতে তলিয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় আমাদের ঘর ভাঙছে, এই রেমালেও ঘর ভাঙছে নদীও ভাঙতে ভাঙতে ঘরের কাছে চলে আসছে। আমরা এখন কোথায় যাব।
পিরোজপুরের সাতটি উপজেলার প্রায় সব গুলোই নদীবেষ্টিত। তাই নদী তীরবর্তী বাসিন্দার সংখ্যাও এখানে অনেক বেশি। কিন্তু নদী তীরবর্তী অধিকাংশ এলাকায় বেড়ি বাঁধ না থাকা ও ভাঙা থাকার কারণে হুমকির মুখে রয়েছে ওই সব এলাকার বাসিন্দারা। পিরোজপুরের কঁচা নদীর পাড় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের কবলে পড়ায় এ নদী তীরের অন্তত চারটি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটান।
ভাঙনের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকায় সংকুচিত হয়ে আসছে এখানকার ভৌগলিক পরিধিও। বর্তমানে গুয়াবাড়ি, বানেশ্বরপুর, দেওনাখালী, কৈবর্তখালী ও কুমিরমাড়া এলাকায় ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তাছাড়া কঁচা নদীর প্রবল স্রোতের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে কুমিরমাড়া গ্রাম থেকে শুরু করে হুলারহাট বন্দর পর্যন্ত এলাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার কলাখালী ইউনিয়নের কৈবর্ত খালি ডাক্তার বাড়ি এলাকার ১১ কিলোমিটার ও পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী টগড়া ফেরিঘাট থেকে হুলারহাট পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ বেড়িবাঁধ রয়েছে।
পিরোজপুর সদর উপজেলায় মোট ৫৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে, যার মধ্যে হুলারহাট অংশেই প্রায় ৫ কিলোমিটার অংশ বর্তমানে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বেড়িবাঁধটি আশির দশকে নির্মাণ করার পরে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সংস্কার করা হয়নি। ২০০৭ সালের সিডর ও পরবর্তী আইলার প্রভাবে বেড়িবাঁধটি প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ঘুর্ণিঝড় রেমালও বেড়িবাঁধটির ক্ষতি করেছে।
পিরোজপুর সদর উপজেলার কলাখালি ইউনিয়নের বাসিন্দা রানেল হাওলাদার বলেন, কলাখালী ইউনিয়নের কৈবর্ত খালি ডাক্তার বাড়ি এলাকার ১১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধটি ভাঙা হওয়ায় প্রতি বছর বন্যা অথবা জলোচ্ছ্বাসে এ গ্রামটি প্লাবিত হয়। এ সময় তলিয়ে যায় মাছের ঘের, পুকুর এবং ঘরবাড়ি। তাই ত্রাণ নয়, স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি আমাদের।
হুলারহাট এলাকার বাসিন্দা মারুফ হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিডর, আম্পান, ইয়াসের রেশ কাটতে না কাটতেই সবশেষ রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে ফের লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে টগরা, হুলারহাট, কলাখালী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা।
বিধ্বস্ত হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন অসংখ্য মানুষ। অবিলম্বে এখানে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করলে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে এই উপকূলীয় এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
এলাকাবাসীর দাবি, ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো আর সংস্কার করা হয়নি। ফলে প্রতি বর্ষণ বা পূর্ণিমার জোয়ারে ফসলি জমি তলিয়ে যাচ্ছে পানিতে। যে কারণে কোন প্রকার ফসল ফলাতে পারেনা কৃষকরা। এতে একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে মানবিক বিপর্যয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ফসিল জমিতে জোয়ারের পানি স্থায়ী হলে ফসলের ক্ষতি হয়। তাই বেড়িবাঁধটি দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন।
পিরোজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নুসাইর হোসেন বলেন, পিরোজপুর সদর উপজেলায় মোট ৫৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে, যার মধ্যে হুলারহাট অংশেই প্রায় ৫ কিলোমিটার অংশ বর্তমানে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
২০০৭ সালের সিডর ও পরবর্তী আইলার প্রভাবে বেড়িবাঁধটি প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। ইতোমধ্যে এই বেড়িবাঁধটির ঝুঁকিপূর্ণ ৩০ কিলোমিটার অংশের নির্মাণে জন্য একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আগামী বাজেটে প্রয়োজন ভেদে বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হবে।
এইচকেআর
