২৬ বছরের ‘মুকুট’ হারাচ্ছেন সুলতান মাহমুদ

দীর্ঘ ২৬ বছরে আধিপত্য ভাঙছে বরিশাল জেলা মোটর শ্রমিক ইনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদের। একই সাথে ১৫ বছরের রাজত্ব হারাচ্ছেন সংগঠনটির সভাপতি সবুর খান সবুজ। তাদের আধিপত্য ভাঙতে সংগঠনটিতে নতুন নেতৃত্ব খুঁজছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
এরই মধ্যে মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাসকে সভাপতি এবং বরিশাল জেলা থ্রি-হুইলার এন্ড হিউম্যান হুইলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার আহমেদ বাবু ওরফে জিএস বাবুকে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক করা হচ্ছে বলে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
সোমবার রাত থেকে এমন গুঞ্জন শুরুর পর থেকেই ক্ষমতায় থাকা বর্তমান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক অনুসারী শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এমনকি জোর করে ক্ষমতা দখল করতে আসলে লকডাউন শেষে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা মোটর শ্রমিক ইনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মাহমুদ।
তবে জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কমিটি ভাঙার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন শ্রমিকের অপর একটি অংশ। তারা বর্তমান কমিটির ২৬ বছরের আধিপত্য ভাঙার উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এমনকি এই সিদ্ধান্তকে দ্রুত কার্যকরের দাবিও জানিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘নগরীর রূপাতলী বাস স্ট্যান্ড কেন্দ্রিক বরিশাল জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নে দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে একই পদে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সুলতান মাহমুদ। সরকার ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও পাল্টেনি সুলতান মাহমুদের পদ-পদবি। বরং যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন সেই দলের নেতাদের সাথে আঁতাত করে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পদে বহাল থাকেন।
শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, ‘সুলতান মাহমুদ জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নকে তার নিজের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়েছেন। দীর্ঘ দিন ক্ষমতা দখল করে থাকা এই নেতা সংগঠনের নির্বাহী সভাপতি পদে আপন ভাতিজা রফিকুল ইসলাম মানিক ও সাবেক কথিত পিএস শহিদুল ইসলাম টিটুকে দিয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরাও দীর্ঘ দিন ধরেই দখল করে আছেন দুটি পদ।
এছাড়া তার পরিবার এবং স্বজনদের মধ্যে থেকে অনেককেই শ্রমিক কার্ড তৈরি করে সদস্য বানিয়েছেন। যারা শ্রমিক কার্ড হিসেবে নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। আর বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত শ্রমিকরা। তার অপর ভাতিজা শামীমকে রূপাতলী বাস স্ট্যান্ডের কাউন্টার ক্লার্কের প্রধানের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। কাউন্টার ক্লার্ক হিসেবে কাজ করছেন তার শ্যালক লিটু, টিটু, নাতি রিজন, ভাগ্নে বাচ্চুসহ অন্যরা। তাছাড়া দীর্ঘ ১৫ বছর সংগঠনের সভাপতির পদ আঁকড়ে থাকা সবুর খান সবুজ আছেন নামেমাত্র। শ্রমিকরা বলছেন সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্বে থাকলেও মূল কলকাঠি নাড়াচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ।
শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, ‘সুলতান মাহমুদ শ্রমিক নন। তিনি চালক লাইসেন্স ব্যবহার করে শ্রমিক নেতা সেজে আছেন। আবার পারিবারিক বিরোধেও শ্রমিকদের ব্যবহার করে বাস বন্ধ রেখে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করানোর অভিযোগও রয়েছে বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। দুই দশকের বেশী সময় শ্রমিক সংগঠনের পদে থেকে হয়েছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। সাধারণ শ্রমিকদের দাবি শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে সুলতান মাহমুদের মাসিক আয় দেড় লাখ টাকার ওপরে। এ কারণেই তিনি সাধারণ সম্পাদকের পদটি আঁকড়ে ধরেছেন বলে দাবি সাধারণ শ্রমিকদের।
এদিকে, ‘দীর্ঘ বছর পরে হলেও সুলতান মাহমুদের সেই আধিপত্য ভাঙতে বসেছে বলে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। শ্রমিকদের একটি বড় অংশ জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নে নেতৃত্বের পরিবর্তন দাবি করছেন। সেই দাবির সূত্র ধরেই ৩১ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ এবং শ্রমিক লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্র।
এমনকি কমিটি গঠন নিয়ে শুরু হওয়া গুঞ্জনের সত্যতার ইঙ্গিত দিয়েছেন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের পদে আলোচনায় থাকা দুই ব্যক্তি। এদের মধ্যে সভাপতি পদে আলোচনায় থাকা মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাস বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এটি কাগজে কলমে অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। অনুমোদন পেলে কমিটির তালিকা পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দেয়া হবে।
সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় থাকা বরিশাল জেলা থ্রি-হুইলার এন্ড হিউম্যান হলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার আহমেদ বাবু ওরফে জিএস বাবু বলেন, ‘এ কমিটি’র কাগজ এখনো আমার হাতে আসেনি। যেহেতু কোন চিঠি পাইনি তাই, আপাতত এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। চিঠি পেলে পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দেয়া হবে।
এদিকে, কমিটি গঠনের গুঞ্জন উড়িয়ে দিচ্ছেন না বরিশাল জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘এ শ্রমিক ইউনিয়ন আমার নিজের হাতে গড়া। গত ২৬ বছর ধরে শ্রমিকদের বিপদে-আপদে থেকে সংগঠন দাঁড় করিয়েছি। এখন কেউ হুট করে এসেই দায়িত্ব নিবে সেটা কিভাবে সম্ভব।
তিনি বলেন, ‘গঠনতন্ত্রের বিধান মোতাবেক শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদক হতে হলে অবশ্যই ন্যূনতম এক বছর শ্রমিক হিসেবে বাস্তবিকভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু পরিমল চন্দ্র দাস এবং শাহরিয়ার বাবু কোথার শ্রমিক’ এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘এটা কোন মালিক বা মাহেন্দ্র সংগঠন নয়, যে একটি মাহেন্দ্র বা বাস কিনেই সদস্য হয়ে যাবে। যারা সভাপতি-সম্পাদক এর পদের আসতে চাচ্ছেন তারা এই সংগঠনেরই সদস্য নন। বিগত দিনে ১৩টি নির্বাচন হয়েছে। এর কোনটিতেই ভোটার তালিকায় তাদের নাম নেই।
সুলতান মাহমুদ আরও বলেন, ‘অন্যায়ভাবে শ্রমিক ইউনিয়ন চাইলেই দখল করা যায় না। কেননা আমাদের এই সংগঠন শ্রম অধিদপ্তরের অধীনে এবং ফেডারেল ইউনিয়নের আওতাভুক্ত। নতুন কমিটি করতে হলে অবশ্যই নির্বাচন করে আসতে হবে। তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। কেউ চাল জালিয়াতি করে ক্ষমতা দখল করতে আসলে তার এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন শ্রমিক নেতা সুলতান মাহমুদ।
তিনি বলেন, ‘কমিটি দখলের গুঞ্জনে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা মঙ্গলবার রূপাতলীতে বিক্ষোভ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে আমরা সেটা করতে দেইনি। লকডাউন শেষে এ নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করা হবে। সংবাদ সম্মেলন করে সকলের মুখোশ খুলে দেয়া হবে। প্রয়োজনে সকল শ্রমিকরা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়ে এর প্রতিবাদ করবেন বলেও হুঁশিয়ার করেন সুলতান মাহমুদ।
এমবি