‘শ্রমিকের পেটে লাথি মেরে লকডাউন হবে না’


৫ বছর ধরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালান জন্টু মিয়া। গতবছর করোনা শুরুর আগে নিজের রিকশা ও গ্রামের বাড়ি থেকে একটি গরু বিক্রি করে ঢাকার ধোলাইখালে শুরু করেন ভাঙ্গারির ব্যবসা। দোকানে দুজন কর্মচারীও রেখেছিলেন। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় সে ব্যবসায় ভাটা পড়ে।
কর্মচারীদের বেতন দেয়া তো দূরে থাক নিজের সংসার চালানোই যেন কঠিন হয়ে পড়ে। এখন সর্বোস্ব হারিয়ে গত ১ মাস হল ফিরেছেন বরিশালে সেই আগের বেশে। তবে এবার আর নিজের রিকশা নয়; দৈনিক ২৫০ টাকা ভাড়ায় অন্যের রিকশা চালাচ্ছেন জন্টু মিয়া। মা-বাবা, দুই ছেলে মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার।
পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিই তিনি। এবার কী হবে, তা ভেবে কূল পান না। করোনা সংক্রমণ রোধে বর্তমানে দেশে কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ থাকা সত্ত্বেও পেটের দায়ে প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের যা দাম, কাজে না বের হলে খাব কী? পেট তো লকডাউন বুঝে না।’
কভিড মহামারিতে বরিশালে চলা রিকশাচালকদের সংসার জীবনের কাহিনিগুলো প্রায় এরকমই। গল্পের ভিন্নতা থাকলেও আর্থিক টানাপড়েনের বিষয়টি একই।
শ্রমিকদের পেটে লাথি মেরে সরকার লকডাউন কার্যকর করতে পারবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের বরিশাল জেলার সদস্য সচিব ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী। তিনি জানান, লকডাউন কার্যকর করতে হলে আগে শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা দিতে হবে। আমরা বলতে চাই, লকডাউন অবশ্যই কার্যকর করতে হবে কিন্তু সেটি সবার হাতে ত্রাণ দিয়ে। একজন শ্রমিক পেটের ক্ষুধায় রাস্তায় নেমেছে। ক্ষুধার্থ সেইসব শ্রমিকদের ওপর একধরণের নির্যাতনই চলছে। এই নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
ডাঃ মনীষা জানান, এর আগে মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তার সাথে কথা হয়েছিল। তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন অন্তত খেটেখাওয়া রিকশা শ্রমিকদের ওপর মানবিক আচরণ করবেন। কিন্তু আমরা খবর পেলাম নগরীর ৬টি পয়েন্টে রিকশা ধরে বসার সিট নিয়ে যাচ্ছে, রিকশা উল্টিয়ে রাখা হচ্ছে। গতবছর সরকার ও বিভিন্নজন ত্রাণ দিয়েছে। কিন্তু এ বছর লকডাউন হচ্ছে, কিন্তু কোন ধরণের সহায়তা করা হচ্ছে না। তাহলে রিকশা শ্রমিকরা কি খাবে?
ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী বলেন, দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে সামান্য বাগবিতন্ডা হলেও তারা শেষে রিকশাগুলো ছেড়ে দিয়েছে। মনীষা জানান, গতকাল মঙ্গলবার নগরীর কাকলীর মোড় পয়েন্টে কমপক্ষে ৫০টি এবং বটতলা পয়েন্টে আরো ৫০টি রিকশা উল্টিয়ে রাখা ছিল। আমরা সেগুলো সোজা করে রিকশাওয়ালাদের বুঝিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া বাকি যেসব পয়েন্টে রিকশা ধরা হয়েছে সেখানেও শতাধিক রিকশা উল্টানো ছিল।
রিকশা শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, প্রথমদফা লকডাউনে অনেকটা অনাহারে রয়েছেন তারা। ধার-কর্জ করে চলেছে। এখন কেউ ধার-কর্জও দিতে চায় না। বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে তাদের।
সোমবার রাতে নগরীর পুলিশ লাইন থেকে রূপাতলী ফেরার পথে জানা গেলে আরেক ভিন্ন গল্প। লকডাউনে রোজগার কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে রিকশাচালক শাহাদৎ জানান, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজমিস্ত্রীর কাজ করি। সন্ধ্যার পরে নামি রিকশা নিয়ে। রাত ১০ টা পর্যন্ত চালাই। অভাবের সংসারে শুধু রাজমিস্ত্রির কাজে সংসার চলছে না। উপায় না পেয়ে রিকশা নিয়ে নামি। সংসার চললে কি আর ৩ বেলা কাজ করি?"
কভিড মহামারির ছোবলে প্রতিদিন শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু দেখছে বাংলাদেশ। প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সরকার গত ১৪ থেকে আগামী ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এর পরে দ্বিতীয় দফায় আবার ৭ দিন কঠোর বিধিনিষেধেরর ঘোষনা দেয়া হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে জরুরি পরিবহন ব্যতীত অন্য সব ধরনের যানবহন। এছাড়া সীমিত পরিসরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতল ও বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে।
এ সব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের চলাচলের অন্যতম বাহন এখন রিকশা। কিন্তু রিকশা চালকদের অভিযোগ রাস্তায় বের হলেই পুলিশ রিকশা জব্দ করে রেখে দেন উল্টো করে। চাকার হাওয়া ছেড়ে দেন। মাঝে মাঝে বেটারি চালিত রিকশার তার টেনে ছিড়ে ফেলেন। আবার ওদিকে চলমান বিধিনিষেধের কারণে এখন যাত্রী পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে বলে তারা জানান।
পুলিশি অভিযানে আটক একাধিক রিকশাওয়ালা জানিয়েছেন লকডাউন তারা অমান্য করতে চান না। কিন্তু পেটের ক্ষুধায় বাধ্য হয়ে সড়কে নেমেছেন। নগরী ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই বিভিন্ন পয়েন্টে রিকশা আটক করা হলেও দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে রিকশাওয়ালা অভিযোগ করেছেন আটকের সময়ে অনেকের রিকশার হেডলাইট ভেঙে ফেলা হয়েছে, অনেক রিকশার চাকার হাওয়া ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ মারধরের অভিযোগ তুলেছেন।
তবে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ জাকির হোসেন মুজুমদার বলেন, প্রাথমিকভাবে রিকশা চালকদের সতর্ক করতে কিছু সময়ের জন্য আটক করা হয়েছিল। পরে মানবিক দিক বিবেচনা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই কর্মকর্তা বলেন, রিকশাওয়ালাদের সাথে কোন ধরণের অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়নি। শুধু আটক করে উল্টে রাখা হয়েছে। এ না হলে রিকশাওয়ালারা সতর্ক হবেন না। অযাচিত যেসব মানুষ নানান অজুহাতে বাইরে বের হয়ে ঘোরাফেরা করছে তাদের নিয়ে চলাচল করে সরকারি নির্দেশনা ভঙ্গ করছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হচ্ছে। প্রথমত সরকারি নির্দেশনা, দ্বিতীয়ত এইসব মানবিকতা। আমরা মানবিক আচরণ না করলে এইসব রিকশাওয়ালা খাবে কি? ফলে তাদের সতর্ক করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে সড়কে লোক অপ্রোয়জনে আসবে না। এখন বর্তমানে তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও সড়কে জনসংখ্যা বেড়ে গেলে আবার কঠোর হতে হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এইচকেআর
