৭১-এর দুঃসহ স্মৃতিচারণে কাঁদলেন শামীম ওসমান


নৌকার সামনে পাট, পিছনে পাট, মাঝে মা-বাবা, দু’ভাই ও দু’বোনের সঙ্গে ভারতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাকিস্তানি গানবোট সামনে এসে হাজির। এরই মধ্যে বাবা ও দু’ভাই আমার মা এবং দু’ বোনের গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরলেন। সিদ্ধান্ত হলো ধরা পড়লে শ্বাসরোধ করে নিজেরাই হত্যা করবে; তারপরও ধর্ষিত হতে দেবে না। এরপর হুমড়ি খেয়ে পড়বেন, যা হয় হবে। এটার নামই স্বাধীনতা।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আর স্মৃতিচাণ করতে গিয়ে বারবার চোখ মুছছিলেন দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিক শামীম ওসমান এমপি। শনিবার রাতে ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের উদ্যোগে একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া ৩৭ সদস্য ও তার পরিবারকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শামীম ওসমান এসব কথা বলেন।
শামীম ওসমান বলেন, আমাদের ভৌগোলিক অবস্থার কারণে এখন একটি গ্রুপ ছোবল মারছে, এতে শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষতি হবে- এমনটা নয়। সকল দলের, সকল মানুষের ক্ষতি হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে দুই ভাগে। একটা গ্রুপ সম্মূখে থেকে যুদ্ধ করেছেন। আরেকটা গ্রুপ দেশ ভাগের পর থেকেই ২৪টা বছর ধরে সেই যুদ্ধ সংগঠিত করেছেন। রাজনীতির প্রতিটি অঙ্ক আমি খুব ভালো করে বুঝি। পথটা এত সহজ ছিল না। তখন সরকারি দলও ক্ষমতায় ছিল না।
শামীম ওসমান বলেন, এখন যদি আবারো যুদ্ধ হয়, কে করবে সেই যুদ্ধ? এখানে যারা বসে আছেন, তাদের অনেকের মা-ই সম্ভ্রম হারিয়েছে, বাবা হারিয়েছে প্রাণ। এখন যে পরিস্থিতি- তারা যদি এসে বলে, স্বাধীনতার দরকার নাই, আমার মায়ের সম্ভ্রম ফিরিয়ে দাও, আমার বাবার প্রাণ ফিরিয়ে দাও। কী করবেন তখন? কিছু কি করার থাকবে?
তিনি বলেন, কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স একটা কথা বলেছিল- হাজার হাজার গেরিলার থেকে, আদর্শবাদী গেরিলা একটা এলাকার জন্য একজনই যথেষ্ঠ। এবং সেটা আপনারা প্রমাণ করেছিলেন। পাক বাহিনীর মতো একটি দক্ষ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। কোন অস্ত্র ছিল না, কোন প্রশিক্ষণ ছিল না। আমি আমার বাবাকে দেখেছি, মহিলাদেরও প্রশিক্ষণ দিতে। কীভাবে প্রলোভন দেখিয়ে একা ঘরে নিয়ে যাবে, গোলমরিচ চোখের মধ্যে দিয়ে তারপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দিবে। আল্টিমেটলি ইজ্জত যাবেই, তারপরও একটা মেরেই নিব। ‘আগে মারো, তারপর মরো’ এই ধরনের কথাবার্তা। কী ত্যাগ করেছেন আপনারা। কিন্তু আমরা আপনাদের সুযোগ্য উত্তরসূরি হতে পারিনি। আমি মনে করি, আপনাদের যথাযথ সম্মান করতে পারছি না।
শামীম ওসমান আরও বলেন, আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে মুক্ত করতে গিয়ে আমার বাবা গুলি খেয়েছিলেন। রেডিও বাংলাদেশ, হাই কোর্ট, বাংলাদেশ টেলিভিশেনেও প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছেন তিনি। তখন তো রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ছিলেন না। এখন তো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। তারপরও কবরস্থানে গিয়ে দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের কী করুণ পরিস্থিতি। আমার বাবা-মায়ের কবর আমি পরিষ্কার করেছি। এখনো কিছু মুক্তিযোদ্ধার কবরের ইটও নাই। ১০০-১৫০ কবরে শ্মশানের মাটি পড়েছে। কার কবর কোনটা, চেনার উপায় নেই। হয়তো মোহাম্মদ আলী ভাইও চুপ করে গিয়ে দেখে এসেছেন। হয়তো ভেবেছেন, আমার কবরেরও এ অবস্থা হবে ভবিষ্যতে! আমি কিন্তু কাউকে দোষারোপ করেনি, এখনো করছি না।
অনুষ্ঠানে ৩৭ জন জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়। তারা হলেন- মোহাম্মদ আলী, একেএম সেলিম ওসমান, মনির উদ্দিন আহম্মেদ, মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, মো. ওসমান গনি ভূঁইয়া, শাহ আলম চৌধুরী, তমিজউদ্দিন রিজভী, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, শেখ হায়দার আলী পুতুল, মো. শাহীদুল্লাহ, আব্দুল কাদির, আব্দুল রাশেদ রাশু, আজহার হোসেন, আব্দুল কাদের, আব্দুল কাদির দেওয়ান, ফয়েজুর রহমান, বেগম ফরিদা আক্তার, গোলাম দস্তগীর গাজী, মো. হাসান ভূঁইয়া, মো. ইব্রাহিম, খবির আহমেদ, মঞ্জুরুল হক, মোসলেহউদ্দিন আহম্মেদ।
আর মরণোত্তর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ক্রেস্ট পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন- প্রয়াত নাসিম ওসমান, মহিউদ্দিন আহমেদ খোকা, মোস্তফা সারোয়ার, দেলোয়ার হোসেন, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বীরপ্রতীক, আফজাল হোসেন, এমএ আউয়াল, চৌধুরী বাচ্চু, মনির হোসেন, মোবারক হোসেন, আব্দুল হামিদ, প্রয়াত শাহ জালাল ও আমিনুর রহমান।
এইচকেআর
