চলে গেলেন সুলেখক মিহির সেনগুপ্ত, বিষাদগ্রস্ত করে গেলেন অসংখ্য গুণমুগ্ধ পাঠককে

প্রয়াত হলেন বিখ্যাত গদ্যলেখক মিহির সেনগুপ্ত। ‘বিষাদ বৃক্ষ’, ‘ধানসিদ্ধির পরণকথা’, ‘টিলা অরণ্যের পাকদণ্ডী’ ইত্যাদি গ্রন্থের লেখক শোকাহত করে গেলেন তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ পাঠককে।
বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। কিছু দিন ধরে ব্লাড ক্যানসারে ভুগছিলেন। সোমবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার একটি হাসপাতালে তাঁর জীবনাবসান হয়। রেখে গেলেন স্ত্রী ও দুই কন্যাকে। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন হুগলির ভদ্রশ্বরের বাসিন্দা।
মিহিরবাবুর জন্ম ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর, তদানীন্তন বরিশাল জেলার, অধুনা বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলার কেওড়া গ্রামে। পাশের গ্রাম কীর্তিপাশার প্রসন্নকুমার উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে এক বছর বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৩ সালে কলকাতায় চলে আসা। পরের বছর প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। স্নাতক স্তরের ছাত্রাবস্থাতেই ব্যাঙ্কের কাজে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে চাকরিরত অবস্থায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যে সম্মান-সহ স্নাতক,
ব্যাঙ্ককর্মী মিহিরবাবুর লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ মধ্যবয়সে – ১৯৯৩ সালে ‘নাইয়া’ পত্রিকার মাধ্যমে। তার পর লেখালেখি করেছেন ‘বর্তিকা’, ‘কালান্তর’, ‘কম্পাস’ ও অন্যান্য কিছু পত্রপত্রিকায়।
উপরে উল্লিখিত তিনটি গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বিদুর’, ‘ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজি’, ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’, ‘উজানিখালের সোঁতা’, ‘টাঁড় পাহাড়ের পদাবলি’, ‘হেমন্ত শেষের পাখিরা’, ‘গোধূলি সন্ধির রাখাল’, ‘নীল সায়রের শালুক’, ‘একুশ বিঘার বসত’ ইত্যাদি।
মিহির সেনগুপ্ত তাঁর আত্মজৈবনিক গদ্য ‘বিষাদবৃক্ষ’-এর জন্য ২০০৫ সালে আনন্দ পুরস্কার। এর আগে ২০০২ সালে বাংলাদেশ শ্রুতি অ্যাকাডেমি ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ গ্রন্থের জন্য তাঁকে ‘শ্রেষ্ঠ রচনা’র পুরস্কারে সম্মানিত করেন।
তাঁর লেখা মূলত স্মৃতি আলেখ্যমূলক। বার বার উঠে এসেছে দেশভাগ, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, বাঙালির জীবনযাপন। বাল্য ও কৈশোরের ভূমি বরিশালকে তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। তাই তাঁর ‘বিষাদবৃক্ষ’, ‘ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজি’, ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’, ‘ধানসিদ্ধির পরণকথা’, ‘ভাটিপুত্রের বরিশালি গদ্যসংগ্রহ’ প্রমুখ লেখায় পাওয়া যায় বরিশালের ভাষা, বরিশালের আখ্যান।
দেশভাগ মিহিরবাবুকে কুরে কুরে খেয়েছে আমৃত্যু। ‘বিষাদ বৃক্ষ’ গ্রন্থের অবতরণিকায় মিহির সেনগুপ্ত লিখেছেন, “যাঁরা পঞ্চাশের ছিন্নমূল কাফেলা, তাঁদের জীবনভর দুঃখ, সংগ্রাম, হারিয়ে ফুরিয়ে যাওয়ার কথা নিয়ে নির্মাণ হয়েছে কত লেখা, ছবি, ছায়াছবি। আজও উপমহাদেশ জুড়ে বন্ধ হয়নি তার হাহাকারি চর্চা, রোমন্থন। কেউ সামগ্রিকতায়, কেউ বা ব্যক্তিক খণ্ডিত গণ্ডিতে অব্যাহত রেখে চলেছেন সেই দুঃস্বপ্নের ব্রতকথা।
“পঞ্চাশের সেই ক্যারাভানের শেষ প্রান্ত আজও চলমান। আরও কতকাল তার প্রবাহ চলবে, কেউ জানে না। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম যারা, যারা সেই পঞ্চাশ/একান্নর নরমেধের রক্ত, বসা, মেদের স্রোত পেরিয়ে আসতে পারিনি, যাদের হতভাগ্য অভিভাবকদের এপারে কোনো সহায় সম্পদ ছিল না চলে এসে স্থায়ী হয়ে, থিতু হয়ে বসার মতো, তারা সেদিন কীভাবে তথাকার স্বাধীন ভূমিতে বেড়ে উঠেছিল বা কতটা নাগরিক অধিকার লাভ করেছিল, এ গ্রন্থ তারই একটি আলেখ্যর প্রচেষ্টা।”
এইচকেআর