মাঝ নদীতে দুর্ঘটনার নেপথে তিন লঞ্চের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা


মাঝ নদীতে তিন লঞ্চের বেপরোয়া প্রতিযোগিতার কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে কয়েক হাজার যাত্রী। তবে এই ঘটনার সময় সুরভী-৭ নামক লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে গেছে একটি বালুবাহী বাল্কহেড। ফেটে গেছে লঞ্চেটির সামনের কিছুটা অংশ। এ ঘটনায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার খবর না পাওয়া গেলেও ডুবে যাওয়া বাল্কহেডে থাকা একজন নিখোঁজ রয়েছে।
বুধবার রাত ১১টার দিকে মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে এই দুর্ঘটনা ঘটে। রাতেই দুর্ঘটনা কবলিত লঞ্চের যাত্রীদের বরিশালে পৌঁছে দিতে বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে এমভি কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চে তুলে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে যাত্রীরা বরিশাল নদী বন্দরে এসে পৌঁছায়। আর দুর্ঘটনা কবলিত লঞ্চটি মেরামতের জন্য মুন্সীগঞ্জের থ্রি-অ্যাঙ্গেল সিপ ইয়ার্ডে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই লঞ্চের মাস্টার হুমায়ুন কবির।
এদিকে, ‘যুগ যুগ ধরে মাঝ নদীতে লঞ্চের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা চলে আসলেও এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে উদাসীন সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তাদের সুষ্ঠু তদারকি এবং অবহেলার কারণেই প্রতিযোগিতা আর দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। এমনটিই অভিযোগ যাত্রীদের। তবে বুধবার রাতের ঘটনায় কোন প্রকার প্রতিযোগিতা হয়ে থাকলে সে বিষয়ে তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপ-পরিচালক এবং বরিশাল বন্দনের যুগ্ম পরিচালক মো. মুস্তাফিজুর রহমান।
সুরভী-৭ লঞ্চের মাস্টার হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বুধবার রাত ৯টার দিকে ৫৩৯ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকা সদরঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশে আমাদের লঞ্চের যাত্রা শুরু হয়। রাত ১১টার দিকে মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীর সংযোগস্থল অতিক্রমকালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাল্কহেড সুরভী লঞ্চকে ধাক্কা দেয়।
তিনি দাবি করেন, ‘বাল্কহেডটিতে কোন প্রকার সাংকেতিক চিহ্ন বা বাতি জ্বলছিলো না। ফলে দূর থেকে বাল্কহেডটিকে দেখা যায়নি। তার ওপর ওই বাল্কহেডটি অপর একটি বাল্কহেডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালাচ্ছিল। এসময় হঠাৎ করেই একটি বাল্কহেড নির্ধারিত পাশ থেকে বিপরিত পাশে গিয়ে চালাচ্ছিলো। তখনই আমাদের লঞ্চের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই বাল্কহেডটি ডুবে যায় এবং সুরভী-৭ লঞ্চের সামনের কিছু অংশ ফেটে যায়। তবে ফেটে যাওয়া স্থান পানির থেকে দূরত্ব বেশি থাকায় বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে এ ঘটনায় মেরিন আদালতে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে, দুর্ঘটনার বিষয়ে পাল্টা অভিযোগ করেছে যাত্রীরা। দুর্ঘটনার জন্য বাল্কহেডটি দায়ি থাকলেও লঞ্চ কর্তৃপক্ষও দায় এড়াতে পারে না বলে দাবি তাদের। সুরভী-৭ লঞ্চে থাকা যাত্রী নগরীর দক্ষিণ সাগরদীর বাসিন্দা মনরঞ্জন মিস্ত্রি বলেন, ‘ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সুরভী-৭, মানামী এবং পারাবত-১৮টি প্রতিযোগিতা করে চলছিলো। এসময় দ্রুত গতিতে চলা সুরভী লঞ্চের সঙ্গে প্রথমে বাল্কহেডটির সংঘর্ষ হয়।
ওই যাত্রী বলেন, ‘বিষয়টি লক্ষ্য না করে মানামী লঞ্চটি সুরভী লঞ্চকে অতিক্রম করার চেষ্টা করলে ওই লঞ্চের সঙ্গেও বাল্কহেডটির ধাক্কা লাগার উপক্রম ঘটে। শুধু তাই নয়, মানামীর পাশে আরও একটি বাল্কহেড ছিলো সেটিও অল্পতে রক্ষা পায়। দুটি বাল্কহেডের মাঝাখান থেকে মানামী লঞ্চটি দ্রুত বেরিয়ে যায়। এসময় মানামীর প্রচন্ড ঢেউয়ের তোড়ে খুব দ্রুতই সুরভী লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লাগা বাল্কহেডটি ডুবে যায়। এসময় সুরভী-৭ লঞ্চের পেছনে ছিলো পারাবত-১৮। এ দুটি লঞ্চের মধ্যে অল্পের জন্য ধাক্কা লাগেনি।
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশার বাসিন্দা তসলিম, কাশিপুরের সামছুল আলম, স্বরুপকাঠির শহিদুল ইসলামসহ একাধিক যাত্রী অভিযোগ করেন, ‘প্রতিযোগিতা করে লঞ্চ চালিয়ে দুর্ঘটনার পর কিছু সময় থামিয়ে রাখা হয় সুরভী-৭ লঞ্চটি। এরপর আবার ওই অবস্থাতেই বরিশালে যাত্রা শুরু করলে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। একপর্যায় যাত্রীদের বাধার মুখে লঞ্চটি তীরে নিয়ে নোঙর করা হয়। এরপর নৌপুলিশ এবং কোস্টগার্ড সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন।
নৌ-পুলিশের কলাগাছিয়া ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. জহিরুল হক বলেন, ‘বালুবাহী বাল্কহেডটি ঢাকার মেডরার দিকে যাচ্ছিলো। লঞ্চের সঙ্গে সংঘর্ষের পর এটিতে থাকা ছয়জন শ্রমিক নদীতে ডুবে যায়। তাদের মধ্যে পাঁচজন জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। তবে একজন নিখোঁজ রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। তবে পুলিশের চোখ এড়িয়ে রাতের আধারে বাল্কহেড কিভাবে চলাচল করে সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
তবে দুর্ঘটনা কবলিত সুরভী-৭ লঞ্চের মালিক রিয়াজুল করিব বলেন, ‘রাতে নৌপথের নিরাপত্তার স্বার্থে বাল্কহেড চলাচল পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ। তার পরও নিয়মিত বাল্কহেড চলাচল করছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে উদাসীন। ঘটনার সময় মানানী এবং পারাবত-১৮ পাশাপাশি অবস্থানে ছিলো। তিনটি লঞ্চটিই বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
অপরদিকে, মাঝ নদীতে লঞ্চের প্রতিযোগিতার অভিযোগ প্রসঙ্গে বরিশাল নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক এবং নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রথমত যে ঘটনা ঘটেছে সেটা আমাদের আওতাধিন এলাকায় নয়। ঘটনাটি ঢাকার মধ্যে ঘটেছে। তবে নদীতে প্রতিযোগিতা করে না চালাচলের বিষয়ে লঞ্চ মাস্টারদের নির্দেশনা দেয়া আছে। তার পরেও কোন যাত্রী অভিযোগ করে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে লঞ্চের অভিযুক্ত মাস্টার এবং চালকদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া বুধবার রাতের ঘটনায় ঢাকা থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তারাও যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
কেআর
