প্রথমবারের মতো নির্বাচনে হারলেন মাহাথির


৫৩ বছরে রাজনৈতিক জীবনে বিশ বছরেরও বেশি সময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মাহাথির মোহাম্মদ প্রথমবারের মতো নির্বাচনে পরাজিত হলেন। নিজের সংসদীয় আসনেই হেরে গেলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার উন্নয়নের নায়ক। এমনকি প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানও পেলেন না। শনিবার মালয়েশিয়ায় ১৫তম সংসদ নির্বাচনের ভোটে লংকাউয়ি আসনে তিনি ৫ প্রার্থীর মধ্যে চতুর্থ হয়েছেন!
জামানত ধরে রাখতে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেতে হত মাহাথিরের; অথচ তিনি পেয়েছেন ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, সাকুল্যে মাত্র ৪ হাজার ৫৬৬ ভোট। ৯৭ বছর বয়সী এ রাজনীতিক দুই দফায় দুই দশকেরও বেশি সময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্ব সামলেছেন। সেই তারই শেষ পর্যন্ত জামানত বাজেয়াপ্ত হল। এর মধ্য দিয়ে এশিয়ার এক সময়ের প্রভাবশালী এ ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেরও ইতি ঘটতে যাচ্ছে বলে অনুমান বিশ্লেষকদের।
লংকাউয়ির ওই আসন জিতেছেন আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিনের পারিকাতান অ্যালায়েন্সের প্রার্থী মোহাম্মদ সুহাইমি আবদুল্লাহ। তিনি পেয়েছেন ২৫ হাজার ৪৬৩ ভোট, দ্বিতীয় হওয়া বারিসান ন্যাশনালের আরমিশাহ সিরাজ পেয়েছেন ১১ হাজার ৯৪৫ ভোট।
২০১৮ সালে এই আসনে মাহাথির পেয়েছিলেন ৩৪ হাজার ৫২৭ ভোট, মোট ভোটের ৫৪ দশমিক ৯ শতাংশ। সেবার তার বিরুদ্ধে বারিসান ন্যাশনালের প্রার্থী পেয়েছিল ২৯ দশমিক ১ শতাংশ ভোট। ১৯৬৯ সালের পর এবারই প্রথম মাহাথির কোনো নির্বাচনে হারলেন।
চলতি মাসে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির বলেছিলেন, হেরে গেলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন। মাহাথির আরও বলেছিলেন, ‘১০০ বছর পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবো, এমনটা দেখছি না আমি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা পার্টির তরুণ নেতাদের মধ্যে স্থানান্তর করা।’
এবারের নির্বাচনে মাহাথির মোহাম্মদ একটি জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে নির্বাচনে প্রচার চালান। তবে এবারের নির্বাচনে তার জোট মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। বারিসান জোটকে এবার মুহিউদ্দিনের জোটের পাশাপাশি মাহাথিরের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিমের জোটের সঙ্গেও লড়তে হয়েছে।
মালয়েশিয়ার এবারের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি কোনো দল বা জোট। এতে দেশটির ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো সংসদে নতুন সরকার গঠনের বিষয়টি ঝুলে গেল। দেশটিতে নতুন কোন দল বা জোট সরকার গঠন করবে তা জানতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। গতকাল শনিবার মালয়েশিয়ায় সাধারণ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়েছে। শুরু থেকেই এই নির্বাচনকে ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন বলা হচ্ছিল।
মালয়েশিয়ার ইতিহাসে এর আগে কখনো সংসদে নতুন সরকার গঠনের বিষয়টি ঝুলে যায়নি। এবার মূলত একটি ইসলামি দলের উত্থানের কারণে এমনটি ঘটেছে। ইসলামপন্থী দলের কারণে বড় জোটগুলো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি।
দীর্ঘ দিনের বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দলীয় জোট পাকাতান হারাপান শনিবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের জোট পেরিকাতান ন্যাশনাল ব্লক। তার জোটের নির্বাচনী প্রার্থীরা বর্তমান সরকারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কয়েকটি আসনে জয় তুলে নিয়েছেন।
মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের জোটে রয়েছে একটি রক্ষণশীল দল এবং একটি ইসলামি দল। এ দলটি মালয়েশিয়ায় শরিয়া আইন চালুর দাবিতে রাজনীতি করে আসছে। মালয়েশিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে নৃতাত্বিক মালয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে চাইনিজ এবং ভারতীয়রা সংখ্যালঘু।
মালয়েশিয়ার নির্বাচন কমিশনের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এবার ২২২টি আসনের মধ্যে ২২০টি আসনে ভোট হয়েছে। এরমধ্যে আনোয়ারের জোট সর্বোচ্চ ৮২টি আসন পেয়েছে। অন্যদিকে মুহিউদ্দিনের জোট পেয়েছে ৭৩ আসন। বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম দেশটিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার চালিয়েছেন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবের ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল জোটের ভরাডুবি হয়েছে; তারা পেয়েছে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০টি আসন। স্বাধীনতার পর ছয় দশক ধরে মালয়েশিয়া শাসন করা বারিসানের এমন ভরাডুবি মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় ধরনের বদলেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ভোটের আগে জনমত জরিপে আনোয়ারকে এগিয়ে রাখা হলেও মুহিউদ্দিনের জোটের অভাবনীয় ফলও অনেককে চমকে দিয়েছে। কট্টরপন্থি বেশ কয়েকটি দলের সমর্থন তাকে বেশ খানিকটা এগিয়ে দিয়েছে বলেও ভাষ্য বিশ্লেষকদের।
মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের জোটে রয়েছে একটি রক্ষণশীল দল এবং একটি ইসলামি দল। এ দলটি মালয়েশিয়ায় শরিয়া আইন চালুর দাবিতে রাজনীতি করে আসছে। মালয়েশিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে নৃতাত্বিক মালয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে চাইনিজ এবং ভারতীয়রা সংখ্যালঘু।
বড় জোটগুলো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় তাদের নিজেদের মধ্যে জোট গঠন করে সরকার গঠন করতে হবে। এছাড়া মালয়েশিয়ার রাজাও হস্তক্ষেপ করতে পারেন। যে কোনো আইনপ্রণেতাকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর এখতিয়ার রাজার আছে।
শনিবারের নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক ভোটার ভোট প্রদান করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্খা থেকে ভোটার উপস্থিতি বেশি ছিল।
নির্বাচনে কোনো জোট এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় মালয়েশিয়ার বর্তমান ধীরগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি আরও ধীর হয়ে পড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এএজে
