বৃষ্টিতে ভিজে গেছ, আমপাতা তুমি...?


আজ পহেলা আষাঢ়। আষাঢ় মাসের প্রথম দিন থেকেই রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি নামবে বাংলাদেশ জুড়ে। শান্ত করবে ধরণীতল। কিন্তু মেঘেঢাকা স্নিগ্ধ আকাশের দিকে তাকালে, তাকে যেন কোনও ভাবেই আষাঢ়ের আকাশ মনে হচ্ছে না। হয়তো এখন সেভাবে বাতাসে আষাঢ়ের বৃষ্টিভেজা জলের স্নিগ্ধগন্ধ কোথাও আর নেই।
সুদূর কোনও গাঁয়ের মেঠোপথে কাদা-বর্ষায় মিলেমিশে যে দারুণ সুভাষ ছড়ানো মাদকতা ছিল। কৈশোরে বৃষ্টিদিনের সেই কাদামেখে বড় হওয়া, বৃষ্টিজলের সেই মাখামাখি, সেইসব ভিজেগন্ধ যেনো কোথাও নেই...। এখনকার ছেলেমেয়েদের মেঘের দলে খেলতে যাওয়ার ফুরসত নেই। তাই তো, জয় গোস্বামীর ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথা’কবিতার এই পংক্তিগুলি যেন এখানে উল্লেখ না করলেই নয়...
“আমি যখন ছোট ছিলাম
খেলতে যেতাম মেঘের দলে
একদিন এক মেঘবালিকা
প্রশ্ন করলো কৌতূহলে
“এই ছেলেটা,
নাম কি রে তোর?”
আমি বললাম,
“ফুসমন্তর !”
... ... ... ...
শুধু কি তাই “ফুসমন্তর!” গ্লোব্লাইজেশনের ধাক্কায় হারিয়ে গেছে জীবনের আরও তো অনেক কিছু। ঋতুর আবর্তনে আষাঢ়ের মেঘমেদুর বর্ষার রঙ-রূপ-গন্ধ কি আর তেমন আগের মতন আছে? আকাশের ঈশানকোণ ঘন অন্ধকার করে হঠাৎ দিগন্ত ঢাকা আষাঢ়ের আগমন ধ্বনির রাজৈশ্বর্য তো, তেমন আর নেই বললেই চলে।
এককালে আষাঢ়ে বর্ষার আগমন বার্তায় মনে হতো যেনো, বহুদূরের আকাশ পেরিয়ে সুদর্শন পথিকমেঘ আসছে আমাদের সব বিষাদ, সব শূন্যতার মাঝে...উজ্জীবনের অবিরল ধারায় ছন্দের মত ছন্দময় কোন কবিতার পংক্তি হয়ে। কেননা, তেমন-ই তো ছিল? আমাদের বর্ষাবন্দনার সেই দিনগুলো। আহা! তেমনি আষাঢ়স্য কেনও আসে না আর? কবিগুরু যেমন বলেছেন,...“এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশানকোণে/ এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল বনে!”...
আহা, এমনি করে বর্ষা আসা মানেই, প্রকৃতির ধূলি-মলিনতাকে লাবণ্যশ্রী করে তুলবে এবং হাজার বছরের গ্রামীণ জনপদ সবুজের প্রলেপ মাখিয়ে দিয়ে, এভাবেই তো, বর্ষা সততই...প্রত্যেক বাঙালির জন্য এক আশ্চর্য বার্তা নিয়ে আসত? বিস্তীর্ণ পৃথীবির পথে পা ফেলে ফেলে মেঘেরাও সুদূরের আকাশ থেকে ধীরে ধীরে ছুটে আসত এই মর্ত্য লোকে।
সেদিনের সেই ছুটে আসা কোমলতা, সুদূরের হলেও এই বার্তা কেবলই নুতনের, চোখ ধাঁধানো আলোয় ঝিলিমিলি সৌন্দর্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দিত। তাই তো, আজও আষাঢ়ে বর্ষায় মেঘের বিপুল আয়োজন আমাদের ভুলিয়ে দেয় নৈমিত্তিক জীবনের দীণতা।
যদিও ঘনিয়ে আসা সেই কালো মেঘের ছায়ায় ঘেরা বৃষ্টিমুখর দিনগুলিতে আমাদের অন্তর খুশিতে ভরে ওঠে। আবার, ঐশ্বর্যময়ী কোনও এক বিদিশার কল্পনায় খুঁজে পাওয়া কোনও শ্রাবস্তির মুখও মনে করিয়ে দিতো অনায়াসেই। হয়তো, কারো কারো মনে বৃষ্টির রিমঝিম সেতারের তানে ছুটে আসা বাদল হাওয়ায় মন ভরে জেগে ওঠে কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ ‘মেঘৈর্মেদুরম্বরং বনভূবশ্যামাস্তমালদ্রুমৈ’এমন শ্লোক কিংবা পণ্ডিত রবিশঙ্করের মুখরিত সেতার এবং রবীন্দ্রনাথের গান। সেই সেতারের সরোদ অঙ্গে যেন বৃষ্টির অমোঘ ধ্রুপদ ও বীণকারি বাড়তি মোটা তারখরজের-পঞ্চম এবং ‘সা’মল্লারও বেজে বেজে ওঠে আমাদের হৃদয়ের ভেতর।
তাই তো বরাবরই আষাঢ়ে বৃষ্টি আর বাতাসের অপরূপ সুরের মূর্ছনায় উচ্ছ্বসিত হয় আমাদের অন্তর। বনে বনে কদম, কামিনী ও চালতার সৌরভে অপার্থিব হয়ে বর্ষার চিরচেনা রূপটি যেন পার্থিবতায় মূর্ত হয়ে ওঠে...ভেজা মাটির সুগন্ধের মতোই অফুরাণ। যদিও আজ, এখনো অনেক বর্তমানের দরোজায় এসে দাঁড়ায় হারিয়ে যাওয়া বহু অতীত, ঠিক যেন তখনকার স্মৃতির ঘন মেঘেঢাকা একেকটি দিন গিয়ে মেশে সেই বহুকাল আগের বর্ষার দিনটির সাথে।
এভাবেই বর্তমান আর অতীত মিলেমিশে একাকার হলেই...“যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে”... এই কথা বলে, তবেই সেইসব দিনের ছায়াও আমরা টের পাই আষাঢ়ের আকাশের দিকে তাকালে। তাই তো, গহন মেঘের আকাশ ঢাকা যে বর্ষা আসে, এমন সব অনুষঙ্গের জন্য বারংবার আমরা রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও গানের কাছে ফিরে গেলেও, আশ্চর্য মরমী সুরের মহিমায়...“শাওনরাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/ বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে”... স্মরণে আসা বিরহীর মর্মবেদনা এবং...“মাদল বাজিয়ে এলো বাদল মেঘ এলোমেলো”... এমনি করে নজরুলের সুরের জাদুতে ঝরোঝরো বাদল দিনের বর্ষাস্নাত এমন পেলবতাও মোরা টের পেয়ে যাই মনে মনে। এভাবেই তো, কবিতা, গান, বাদ্যের সুরে সুরে বৃষ্টি-বিলাসের ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজিয়ে দেয় আমাদের চারপাশের প্রকৃতি ও মন দুটোকেই।
এভাবেই অন্য এক জগতের দরজা খুলে গন্ধবন্ধনের পায়রা উড়ে বেড়ায় আষাঢ়ের আকাশে আকাশে।
কেননা, যে গন্ধবন্ধনের বুকে মুখ রাখলে শিশু খুঁজে পায় তার মাকে। ঠিক তেমনি হয়তো, মেঘ-মেদুরের গহিনে ভেসে ভেসে সব প্রেমিকও পৌঁছে যেতে চায় তার প্রেয়সীর শরীরের গন্ধের টানে। আর আষাঢ়ের মেঘে মেঘে ভেসে আসা? সে-তো, রামগিরি পাহাড়ের উঁচু থেকে নেমে আসা দূর কোনও সুদূরের অলকা ও অবন্তী-উজ্জয়িনী বর্ষার রূপ। যে রূপ একালের বৃক্ষবিরল ধূসর নগরীকেও সবুজের সমারোহে সাজিয়ে দেয়, একালের-সেকালের উজ্জয়িনী রূপের দ্রৌপদিকেও...!
আষাঢ়ের রাত বাড়লেই কালো ঘন হয়ে উঠতে থাকে ড্রামগলানো বিটুমিনের মতো অন্ধকার। অন্ধকারের সেই গাঢ় নির্জনতায় বৃষ্টি আরও মিহিন সুরেলা হয়ে উঠতে চায় মোৎর্জাটের সিম্ফনিতে। হয়তো বা বৃষ্টি ঝরার শব্দ আরও ছন্দময় হতে হতে আশ্চর্য এক গুঞ্জরণের সুরে বেজে ওঠা কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের অসাধারণ কণ্ঠের সুরে...“দূরে কোথায় দূরে দূরে'... গানের গভীর ব্যপ্তি ছড়ানো সংগীতের আবাহনে মুগ্ধ হতে কার না মন চায়? তাই, বর্ষার গভীর রাত মানেই তো?
এখনও রবীন্দ্রনাথ ও কণিকা এ দুয়ের এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে মুগ্ধ হয়ে যায় অনেকের অন্তর। রবীন্দ্রনাথের কথা ও সুরের মিলনে যে অর্ধনারীশ্বর রূপ, আহা! কতো শিহরণ জাগিয়ে দেয় হৃদয়ে মনের কোণে বারবার।
আজকাল অনেককেই বলতে শুনি, একটানা ৪/৫-দিনের ঝুম বৃষ্টিতে প্রকৃতির চিরচেনা সবকিছুই অচেনা হয়ে যেত, বৃষ্টিজলের থৈথৈ স্রোতে পরিপূর্ণ হয়ে যেত মাঠঘাট ধানক্ষেত গ্রামীণ অবয়ব। কাদাময় মাঠের বৃষ্টিতে ভিজে দ্বিগুণ উৎসাহে ফুটবল খেলেছেন, এমন স্মৃতি অনেকের ভাণ্ডারেই আছে হয়তো। যদিও এখনকার সব শিশু কিশোররাই বৃষ্টিবিলাসের এমন আশ্চর্য আনন্দ থেকে বঞ্চিত। শুধু কি তাই? আজকাল তো, বর্ষার সব আনন্দ-দু:খ-বেদনা একাকার জীবনের চারদেয়ালে ঘরবন্দী।
গ্রীনহাউজ এফেক্ট, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন এই দুইয়ের মিশ্রণেও মেঘকোমল আকাশ আর শ্যামশোভাময় বন-তমালের লাবণ্যহীনতায় ঘিরে ধরে আছে আমাদের চারপাশ। তাই তো, আষাঢ়ের সারাদিন একটানা বৃষ্টি, অজস্র ধারায় বর্ষা ঝরবার দৃশ্য, সেসব কি আছে আজকাল? প্রতিবছর নিয়মিত বর্ষাকাল আসে বটে, কিন্তু সেই চিরচেনা রূপের বর্ষা দেখার সৌভাগ্য হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে সবুজের মৃত্যুর কারণে গ্রীষ্মের দাবদাহ বাড়ছে অনেক গুণ। বিপরীতে বর্ষার ঘনঘটা মোটেই দেখা যাচ্ছে না। যে তুমুল বর্ষা আসার কথা ছিল, সে মুষলধারে ঝরঝর আষাঢ়ের আগমনী বার্তা নিয়ে সে আর আসছে না কোথাও।
তবুও বাংলায় বর্ষা এলে প্রকৃতিতে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তেমনি মানুষের হৃদয়বীণার তারেও সেই বর্ষাধ্বণি বেজে উঠবে বারংবার। বর্ষা মানুষের মনকে উদাস করে দেয় আবার আনন্দও এনে দেয়। এবং প্রকৃতিকেও ঐশ্বর্যময় করে তোলে। কেননা, বর্ষায়ই তো, ঝমঝম বৃষ্টি হয়ে ধানের ক্ষেতের ওপর দিয়ে দুরন্ত বাতাসের সবুজ ঢেউ বইতে থাকে, ডোবা-নালা থেকে ব্যাঙের ডাক, দীর্ঘ কর্মহীন জীবন, নানারকম ফুল-ফল আর ফসলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠা? এটাই তো, আমাদের আষাঢ়ষ্যকাল।
তাই তো, আমাদের মনের কোণে, সেই নির্জন বর্ষার ছবিটাই জীবন্ত হয়ে আছে আজও। কেননা, বহুবছরের ওপার থেকে আজও বয়ে আনে সে যুগের সেই মেঘমেদুর দিনের স্মৃতি। তাই, বর্ষা মানেই বাংলার দিগন্ত বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র আর কবিমনের মাঝে একটা নতুন প্রাণ এনে দেয়ার গন্ধবন্ধন। এ-এক আশ্চর্য অনুভূতি। তারপর, বৃষ্টির সময় যখন বাংলাদেশের সব ডোবা-নালা, পুকুর-দীঘি, নদ-নদী জলে পরিপূর্ণ হয়, কানায় কানায় সেই পরিপূর্ণতার দৃশ্যই তো? ঢেউ হয়ে এখনো আমাদের হৃদয়ে খেলা করে।
তাই, বর্ষা-আবাহনে কবি জয় গোস্বামীর ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল কাব্যোপন্যাসের নায়িকা যেভাবে তার নি:সঙ্গ লাজুক হৃদয়ের গোপন প্রেম-অপ্রেমের মিলন বুঝতে পেরেছিল বেদনা বিধৃত আমপাতা।...“বিষন্ন বর্ষার দিনে শ্রাবণের স্নান সেরে ভিজে গেছ ভূমি/ ভিজে যারা গিয়েছিল তার সাথে ভিজে গেছ, আমপাতা তুমি?”...
লেখক : কবি ও দৈনিক মতবাদের যুগ্ম সম্পাদক।
এমবি
