শেখ হাসিনার বিচারকাজ শেষ, রায়ের দিন নির্ধারিত হবে ১৩ নভেম্বর


জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ১৩ নভেম্বর এ মামলার রায়ের দিন নির্ধারণ করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) দুপুর সোয়া ১২টায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আজ বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে বিচারকাজ শুরু হয়। প্রথমেই শেখ হাসিনার মামলায় সমাপনী বক্তব্য দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ হেভিওয়েট নেতাদের যেভাবে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেসব বর্ণনা ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন তিনি। একইসঙ্গে শেখ হাসিনা ও কামালের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন। পরে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর যুক্তি উপস্থাপনের কয়েকটি বিষয়ে জবাব দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরপর তাদের কিছু কথার পাল্টা উত্তর দেন স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী আমির হোসেন।
এ বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং এই আইন নিয়ে তাদের যে যুক্তি সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা বলার চেষ্টা করেছি যে, আমরা এখানে যেসব এভিডেন্স উপস্থাপন করেছি তা হিমালয়ের মতো দৃঢ়। ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ। এসব এভিডেন্স দুনিয়ার যেকোনো আদালতে যদি তুলে ধরা হয়, তাহলে এই অপরাধীদের অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে। আমরা লাইভ উইটনেস, ডিজিটাল এভিডেন্স এনেছি। যারা এই এভিডেন্সগুলো জেনারেট করেন যেখানে তিনি কথাগুলো বলেছেন সেসব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আদালতে উপস্থাপন করেছি। যাকে অর্ডার দেওয়া হয়েছে তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আদালত আগামী ১৩ নভেম্বর তারিখ নির্ধারণ করেছেন। ওইদিন ঘোষণা করা হবে কবে রায় দেওয়া হবে।
গতকাল বুধবার বিকেলে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেছেন, এ মামলায় পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত (স্টেট ডিফেন্স) এবং উপস্থিত রাজসাক্ষী (আসামি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। প্রসিকিউশনের পক্ষে আমরা জবাব দেবো। তবে কিছু অংশ আমরা উপস্থাপন করে জবাব দিয়েছি। চিফ প্রসিকিউটর ও অ্যাটর্নি জেনারেল সমাপনী বক্তব্য রাখবেন। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে এ মামলার রায়ের জন্য দিন ধার্য হবে।
গতকাল বুধবার বিকেল সোয়া ৩টার পর আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক শেষ করেন স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী মো. আমির হোসেন। টানা তিনদিনের যুক্তি উপস্থাপন শেষে হাসিনা-কামালকে নির্দোষ দাবি করে খালাসের আবেদন করেন তিনি। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সোয়া ৩টা পর্যন্ত তার যুক্তিতর্ক চলে। পরে যুক্তি উপস্থাপন করেন রাজসাক্ষী মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। তিনিও মামুনের খালাস চেয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, সুলতান মাহমুদসহ অন্যরা।
গত ২১ অক্টোবর দুপুরের পর দ্বিতীয় দিনের মতো যুক্তি উপস্থাপন করেন আমির হোসেন। ওই দিন সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি নিয়ে বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি। ২০ অক্টোবর পলাতক আসামিদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত এই আইনজীবী। তিনি নিজের যুক্তিতর্কে শেখ হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষে আনা অভিযোগসহ বিভিন্ন বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামল, একাত্তরের পটভূমি, শাপলা চত্বরে হত্যাযজ্ঞ ও ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের কথা তুলে ধরেন।
এর আগে, ১৬ অক্টোবর টানা পাঁচদিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে প্রসিকিউশন। ওই দিন হাসিনা-কামালের চরম দণ্ড (মৃত্যুদণ্ড) চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। একইসঙ্গে রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের শাস্তির বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেন তিনি।
টানা পাঁচদিনের যুক্তিতর্কে একাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ইতিহাসসহ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের শাসনামলের চিত্র তুলে ধরেন তিনি। গুম-খুন, হত্যাযজ্ঞের বর্ণনাও দেন তিনি। এছাড়া এ মামলায় গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়।
গত ৮ অক্টোবর মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে তৃতীয় দিনের মতো জেরা শেষ করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। এরপর যুক্তিতর্কের জন্য দিন নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল-১। এ মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
এ মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়েছে। তবে নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে এরই মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। এ বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
এইচকেআর
