২০৩৫ সালের মধ্যে স্কুলের বাইরে ও কর্মহীন থাকবে ৭ কোটিরও বেশি তরুণ

২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ৭ কোটিরও বেশি তরুণ-তরুণী স্কুলের বাইরে ও কর্মহীন অবস্থায় থাকবে, যেখানে তরুণীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ সমস্যাটি এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
নারীদের ক্ষেত্রে সামাজিক রীতিনীতি, নিরাপত্তা এবং গৃহস্থালি ও শিশু যত্নের দায়িত্ব তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগকে আরও সীমিত করে দিচ্ছে, বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সমস্যাগুলো মোকাবিলায় বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছে, যা তাদের গত মাসের ব্লগ পোস্টে প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক মনে করে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি-নিয়মের পূর্বানুমানযোগ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা, সঠিক ভৌত ও ডিজিটাল অবকাঠামো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং সংকট মোকাবিলায় মৌলিক ভূমিকা পালন করবে।
পাশাপাশি, কৃষি ব্যবসা, অবকাঠামো, উৎপাদনশিল্প, স্বাস্থ্যসেবা এবং পর্যটনের মতো কর্মসংস্থানসমৃদ্ধ খাতে বাধা দূর করতে এবং বেসরকারি উদ্যোগকে সহায়তা দিতে লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্বব্যাংকের এ লিখনিতে বলা হয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ৭ কোটিরও (৭০ মিলিয়ন) বেশি তরুণ-তরুণী স্কুলের বাইরে এবং বেকার অবস্থায় থাকবে। একই সঙ্গে এ অঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ জনমিতিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে। কারণ তখন ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটিতে (৩০০ মিলিয়ন) পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে অর্ধেক শিক্ষায় থাকবে, এক-চতুর্থাংশ কোনো না কোনো কাজে যুক্ত হবে। বাকি এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ সাত কোটিরও বেশি তরুণ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বাইরে থেকে যাবে। শিক্ষায় বা কর্মে যুক্ত নয় এমন বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
এ সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তরুণীরা। গভীরভাবে প্রোথিত সামাজিক রীতিনীতি, নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং গৃহস্থালি ও শিশু যত্নের দায়িত্ব তাদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণকে কঠোরভাবে সীমিত করছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে মাত্র একজন কাজ করেন, যা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের গড়ের অর্ধেক।
লিঙ্গ বৈষম্য, নিরাপদ যাতায়াতের অভাব এবং পর্যাপ্ত শিশু যত্ন সুবিধার ঘাটতির মতো সমস্যাগুলো নারীদের কাজের সুযোগ আরও কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে তারা দেশের অর্থনীতিতে যথাযথভাবে অবদান রাখতে পারছেন না।
এ সংকট মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক সুপারিশ করেছে যে শ্রমবাজারের সরবরাহপক্ষে দেশগুলোকে ৩৫ বছরের কম বয়সী কর্মী (সব কর্মীর দুই-তৃতীয়াংশ) এবং নারীদের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ নারী কর্মজীবনে যুক্ত, যা অন্যান্য অঞ্চলের গড়ের অর্ধেক। এছাড়া শিক্ষা ও অর্থায়নে প্রবেশাধিকার খর্বতা দূর করা, সাশ্রয়ী শিশু ও বৃদ্ধদের যত্ন নিশ্চিত করা, নিরাপদ যাতায়াত ও কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা করা এবং ঘরে ও কাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমানো গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বব্যাংক মনে করে এত বিপুল সংখ্যক তরুণের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা হুমকির মুখে ফেলছে এবং সামাজিক অসন্তোষ তীব্র করছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণদের হতাশা নানান দেশে বড় বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তারা জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং কর্মসংস্থানের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। যদি দ্রুত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে এ হতাশা আরও গভীর হতে পারে।
আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বাড়ানো, কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ উন্নত করা এবং শহর-গ্রাম উভয় এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে। একই সঙ্গে নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল, সাশ্রয়ী শিশু যত্নসুবিধা এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে, যাতে আগামী দশকে শ্রমবাজারে প্রবেশ করা তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ তৈরি হয়।
যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ জনগোষ্ঠী উৎপাদনশীলতা, উদ্ভাবন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হতে পারে। কিন্তু যদি উপেক্ষা করা হয়, এটি অঞ্চলের অন্যতম গুরুতর উন্নয়ন সংকটে পরিণত হবে। এখন নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো—বিশেষ করে তরুণী ও পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা লাখো মানুষের ভবিষ্যৎ—নির্ধারণ করবে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্ম আগামী বছরগুলোতে সমৃদ্ধির ভিত্তি হবে নাকি অস্থিরতার উৎস।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণরা চাকরির জন্য অধীর হয়ে উঠেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে একটি চাকরি হলো দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ—একটি অর্থবহ, মর্যাদাপূর্ণ ও আত্মসম্মানবোধে পরিপূর্ণ জীবনের ভিত্তি। একই সঙ্গে তারা এটাও দেখছে যে তাদের অর্থনীতি তাদের জন্য যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না।
ফলে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেপালের জেন জি প্রজন্মের তরুণরা—যারা প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানকে বাধাগ্রস্ত করা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিল—সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও বৈষম্যমূলক চাকরির কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হতে হয়। তার দুই বছর আগে, শ্রীলঙ্কায় অব্যবস্থাপিত অর্থনীতির বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভে দেশটির প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যান।
বর্তমানে নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সরকারগুলো সেই তরুণদের প্রত্যাশা পূরণে সংগ্রাম করছে, যারা তাদের ক্ষমতায় এনেছিল। এই প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকতে হবে কর্মসংস্থানকে। অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সরকারও এ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।
এইচকেআর