ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Motobad news

সুন্দরবনে সুপেয় পানির অভাব!

সুন্দরবনে সুপেয় পানির অভাব!
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের মিঠা পানির পুকুরে লবণ পানি প্রবেশ করেছে। এতে মিঠা পানির পুকুরগুলো লবণ পানিতে সয়লাব  হয়ে গেছে।

এসব পুকুরের পানি সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ সহ বন্যপ্রাণী, বনজীবী, পর্যটক ও বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মিঠাপানির একমাত্র উৎস ছিলো। এমনকি জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনে যাওয়া  মৎস্যজীবী, মৌয়াল, বাওয়ালিদের রান্নাবান্না ও খাওয়ার পানির ভরসা বনের গহীনের এই পুকুরগুলো।  

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে স্মরণকালের সর্বোচ্চ জলোচ্ছ্বাস- স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৭ ফুট পানি বৃদ্ধির কারণে এসব পুকুর ডুবে যায়।

ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের লোনা পানিতে সুন্দরবন বেশ কয়েকদিন তলিয়ে ছিল। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে বন্যপ্রাণীদের উপর। বনের হরিণগুলো ছিলো বেশি বিপদে। বনজীবীরা জানান, প্লাবনের সময় জীবন বাঁচাতে দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করে বনের হরিণ।

একই রকম আচরণ ছিলো বানরসহ আরো অন্যান্য প্রাণীর। বন কর্মকর্তারা জানান,  সুন্দরবনে কয়েকটি হরিণ লোকালয়ে চলে আসে এবং কয়েকটির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সুন্দরবনে উঁচু ভূমির অভাব, তাই প্লাবন হলে বহু প্রাণী জীবন বাঁচাতে পারে না।
করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আজাদ কবীর  বলেন, এত পানি যে হবে তা কখনও কল্পনা করা যায়নি। আমি ১২ বছর ধরে সুন্দরবনে আছি। জোয়ারে এত পানি কখনও দেখিনি। অন্যান্য ঝড়ে যে পানি উঠেছে ইয়াসে তার থেকে করমজলে দুই তিন ফুট পানি বেশি উঠেছে। অন্য বছর পানি উঠে নেমে গেলেও এবার পানিটা দীর্ঘ সময় ছিলো। উঁচু টিলা করে দিয়ে পাশে পুকুর করে দিলে বন্যপ্রাণীরা জলোচ্ছ্বাসের সময় সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর একমাত্র সুপেয় পানির উৎস ছিল মিঠা পানির পুকুর। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পশ্চিম সুন্দরবনের ৫৪টি সুপেয় পানির পুকুরের মধ্যে ৫৩টি ডুবে গেছে। সাতক্ষীরা রেঞ্জে মাত্র একটি পুকুরে পানি ঢোকেনি। প্রবল বাতাসে প্রায় ১১টি জেটি ভেঙে গেছে। কয়রা ও বজবোজায় দুটি কাঠের অফিস ভেঙে গেছে। জেটি থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার প্রায় ৩০টি মাটির রাস্তা জলোচ্ছ্বাসের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস-জোয়ারের পানিতে বেশ কিছু ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের । স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কোথাও ৭ ফুট কোথাও ৮ ফুট বেশি জোয়ারের পানি উঠেছে। তবে দুটি হরিণ ছাড়া অন্য বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। গাছ-গাছালির ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। ৫৪টি মিঠা পানির পুকুরের মধ্যে ৫৩ টিতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে লবণ পানি প্রবেশ করেছে। এতে বন্যপ্রাণী ও বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুপেয় পানির ব্যাপক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী হরিণসহ বন্যপ্রাণীরা সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতো এসব পুকুর থেকে।

সুন্দরবনের মিঠা পানির পুকুর ডুবে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীর কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, মানুষের যেমন পিপাসা পায় বন্য প্রাণীদেরও তেমন পায়। বন্যপ্রাণীরা লবণাক্ত পরিবেশে বাস করলেও তারা কিন্তু মিষ্টি পানি পান করে। ফলে এখন সুন্দরবনে যেটা হচ্ছে যে বন্যপ্রাণী তৃষ্ণায় বাধ্য হয়ে লবণাক্ত পানি পান করবে এতে দেখা যাবে তাদের নানা ধরনের শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটছে। কারো কারো পেটের পীড়া হবে। এই সব বন্যপ্রাণীদের  বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা তৈরি হবে। আমরা যেহেতু এগুলো মনিটরিং করি না তাই এগুলো বুঝতে পারি না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তাদের জীবন চক্র এবং তাদের শরীরবৃত্ত যেটাকে বলে তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আসবে।  অনেক প্রাণী রোগাক্রান্ত হবে এবং তাদের প্রজনন থেকে শুরু করে শরীর বৃত্তীয় নানা কর্মকা-ে পরিবর্তন তৈরি হবে। মারাও যেতে পারে কিছু প্রাণী। যখন গহীন বনে বন্যপ্রাণী মারা যায় সেগুলো স্বাভাবিকভাবে মানুষ বুঝতে পারে না। অনেক সময় তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা খাবারের সন্ধানে  সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলিতে চলে আসে। গ্রামবাসী, জেলে বা মৌয়ালীরা তাদের চোখে পড়লে সেগুলি জানাজানি  হয়। কিন্তু গভীর বনে যেগুলো মারা যায় এগুলো বেশিরভাগই সময় জানা যায় না।  

 ফলে দেখা যাচ্ছে এই লবণপানি পান করার কারণে ছোট যে হরিণ সাবক আছে বা ছোট যেসব প্রাণী আছে তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুন্দরবনের মিঠা পানির পুকুরে যে লবণ পানি প্রবেশ করেছে তা থেকে উত্তরণের বিষয়ে কোনো পরামর্শ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, এই মুহূর্তে লবণ পানি তুলে ফেলার কোনো সুযোগ নাই। জোয়ারের পানি চলে গেলে আস্তে আস্তে বৃষ্টির পানিতে লবণাক্ততা কমে আসবে। এবং প্রাণীরা খাপখাইয়ে নিতে পারবে। ভবিষ্যতের জন্যে এই যে পুকুরগুলো আছে জলোচ্ছ্বাসের যে উচ্চতা সেটাকে মাথায় রেখে পুকুরগুলোর পাড় উঁচু করতে হবে এবং ঢালু করে দিতে হবে। যাতে করে বাইরের পানি পুকুরে ঢুকতে না পারে। বাইরে থেকে পানি এলে ঢালুর পাড়ের কারণে পানি উপরে উঠতে পারবে না।

বনের মধ্যে পুকুরের পাড় বাঁধাই করা টেকসই হবে না লবণের কারণে। কারণ ইট, বালু, সিমেন্ট এক সময় ক্ষয়ে যাবে। ফলে পাড় বাঁধাইয়ের চেয়ে যদি মাটি দিয়ে পাড় উঁচু করে দেওয়া যায় এবং ঢালু করে দেওয়া যায় সেটা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।
 


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন