ঢাকা শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫

Motobad news

করোনাক্রান্ত বাংলা নববর্ষ অন্তর্জালেই পালিত হোক

করোনাক্রান্ত বাংলা নববর্ষ অন্তর্জালেই পালিত হোক
ছবি : সংগৃহীত
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

আজ উৎসববিহীন বাংলা নববর্ষ। গত দিনের চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে ১৪২৭ বঙ্গাব্দকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ যুক্ত হলো নতুন বছর ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। আজ সকালে ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। কিন্তু সে স্বপ্ন, করোনা অতিমারীর কারণে, করোনা মহামারীর কবল থেকে সহসা মুক্তির প্রত্যাশা নিয়েই আজ প্রথমবারের মতো নতুন বছরকে বরণ করে নেবে তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই।  


পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব। নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথ চলা। বুকভরা তেমনি প্রত্যাশা নিয়ে নতুন উদ্যমে ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি আজ আরো সোচ্চার হবে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মৌলবাদ ও জঙ্গি নিধনের আশায়। কেননা, বাংলা নববর্ষের মহামিলন ও আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কুপমণ্ডকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা পায়, এবং সেই সাথে আমাদের চারপাশের সকল অপশক্তি ও অসুর শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি বরাবরই সার্বভৌমত্বের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠতে জানে।
বিশেষত, গত এক দশকে  বাংলা নববর্ষ সর্বজনীন জাতীয় উৎসবে রূপ নেয়ার ফলে, পহেলা বৈশাখ উৎসবটি এখন ব্যবসায়ীদেরও বাণিজ্যের বড় একটি উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। 


প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখের বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই ঘরে-বাইরে বাংলা বর্ষবরণের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ফেরিওয়ালার ঝুড়ি থেকে ফুটপাত, শপিং মল, মেলার প্যাভিলিয়নে সব জায়গায়ই থাকে বৈশাখী বেচাকেনার ধুম। অথচ, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গত বছরও যে মন্দার চিত্র তৈরি হয়েছিল। এবারও সেই পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে আরও বেশি। করোনা পরিস্থিতির এই অতিমারী ঠেকাতে ইতোমধ্যে সরকার প্রদত্ত লকডাউনের কারণে পরিবহন সংকট, দোকানপাট সীমিত পরিসরে খোলা থাকার আইনী সিদ্ধান্তের কড়াকড়ি এবং সর্বোপরি করোনাভীতিতে সর্বত্রই ক্রেতাসংকটের জন্য ফের বৈশাখী বেচাকেনা সংকুচিত হয়েছে শত-শতাংশের মতোই। করোনা মহামারীতে গত বছর থেকেই ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারানোর রথে নিশ্চুপ উঠে বসে আছেন। অন্তত ভেবেছিলেন, এ-বছর পহেলা বৈশাখ আর ঈদুল ফিতরকে উপলক্ষ্য করে ঘুরে দাঁড়াবেন তাঁরা। কিন্তু আতিমারীর অস্বাভাবিকতায় ব্যবসায়িদের ঘুরে দাঁড়ানোর সেই স্বপ্ন পুরোটাই গ্রাস করে নিয়েছে কোভিড নামক এক হাঙর পরিস্থিতি। কেননা, ফের প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস আবারো ভয়াবহভাবে ফিরে আসায়, এবারো ব্যবসায়িদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত গড়ে নেয়ার সেই স্বপ্নটাই স্বপ্নই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। 


করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় নববর্ষ উদযাপনের সকল আয়োজন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল, করোনা আবিষ্কারের মহামতি চীন সরকারও। ধীরে ধীরে করোনা ছড়িয়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। আনন্দ-বিনোদনের সব আয়োজন গুটিয়ে ঘরবন্দি হয়েছে সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতির মানুষ। করোনাকে এড়িয়ে জীবনরক্ষার তাগিদে প্রত্যেক মানুষকে একেবারে ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে অনেকটা সময়। জীবন বাঁচাতে এখন একাকীত্ব পালনই যেন সবচেয়ে কার্যকর উপায়...! 


সম্প্রতি, আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠেছে, বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাস আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন বাতাসের মতোই হু-হু করে বাড়ছে। তাই, জীবনকে সামাজিক দূরত্বের শৃঙ্খলে আরো কঠোরভাবে আবদ্ধ করা এখন আরো খুব বেশি দরকারী হয়ে পড়েছে। যদিও, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক বিনোদনের বিভিন্ন আয়োজন থেকে শুর” করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উৎসব অনুষ্ঠানও কাটছাট ও স্থগিত করা হয়েছে। উপর্যপরি দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছুটি। মসজিদ-মন্দির গির্জাসহ সব উপাসনালয়ে না গিয়ে সরকারি নির্দেশ মেনে ঘরেই উপাসনা শুরু করেছে ধর্মানুরাগী সব ধর্মের মানুষ। ফলে, আজ ১৪২৮ বঙ্গাব্দকে নানা নিয়মের কঠোর লকডাউন মেনেই বরণ করতে চলেছে বাঙালি জাতি। তবে, এবার যেক্ষত্রে যেখানে যা কিছু উৎসব হবে, তা সামাজিক দূরত্ব মেনে, ঘরেয়া পরিসরেই হতে হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের  উদ্যোগে রমনার বটমূলে...“এসো হে বৈশাখ এসো এসো'' গেয়ে  শুরু হবে না নববর্ষ উদযাপনের চিরায়ত অনুষ্ঠান। রাজধানীর রাস্তা জুড়ে চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রাও বের হবে না এবার। শহর-গ্রামের নানা প্রান্তে বসবে না বৈশাখী মেলা। বরং অতি উৎসাহী কেউ যাতে নববর্ষ উদযাপনের জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে না পড়ে, তা-ও অতি কঠোরভাবে নিশ্চিত করবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 


এবারের এমন পহেলা বৈশাখ উদযাপনের চিত্র হয়তো এর আগে কখনোই দেখেনি বাংলাদেশ। সময় অসময়ে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছে, ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণও গেছে বহু  মানুষের, তবু প্রতিবছর প্রতি পহেলা বৈশাখে প্রাণের টানে উৎসব আমেজে দলে দলে বেরিয়ে পড়ছে মানুষ। কিন্তু করোনা সংকটে সারাবিশ্বই তো এখন উৎসবহীন। তাই, বাংলাদেশেও থাকছে না বাংলা নববর্ষ আয়োজনের ঘনঘটা। তবে ঘরে বসে যেভাবে অফিসের কাজ চলছে, উপাসনা চলেছে, সেভাবে উৎসব উদযাপনে কোনো বাঁধা নেই। বাঁধা নেই, কারণ, ইন্টানেটের মাধ্যমে দূর থেকে হলেও এ বছরে বাঙালির প্রাণের সংস্কৃতিক উৎসব পালিত হবে আন্তর্জাল সংক্রান্ত প্রযুক্তিতে...। 


কেননা, এ-বছর আগে-ভাগেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পহেলা বৈশাখের সমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। সারা দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে। এটা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তাই এবার কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নতুন বর্ষকে বরণ করে নেওয়া হবে। সারা দেশের ন্যায় বরিশালেও উদীচি’র  বৈশাখি সব আয়োজন বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় বরিশাল চারুকলার আয়োজিত বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিস করবে এখানকার সকল সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। তবে, সরকারি এবং বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতারে বাংলা নববর্ষের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।


আমার  তো জানি যে, কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু হয়েছিল মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও, নানা কারণে এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের  শেষে তা বাঙালিয়ানায় বিশেষ মাত্রা পায়Ñ রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলার এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কোর বিশ্ব বিবেচনায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদাও দেয়া হয়েছে।


বর্তমান করোনা দুর্যোগ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা নববর্ষ উৎসব উদযাপন করা কোনওভাবেই সম্ভব নয়। তবুও, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাঙালি করোনা মহামারি থেকে সহসা মুক্তির প্রত্যাশা নিয়েই তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আজ নতুন বছরকে বরণ করে নেবে, ফের ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে...!


 


এমবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন