বরিশালে কমিটি নিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না বিএনপির
কমিটি নিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির। অর্থের বিনিময়ে একের পর এক কমিটি গঠনের অভিযোগ উঠে আসে কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কমিটি বাণিজ্যের একটি অডিও ভাইরাল হয়। সেই অডিওতে পদ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে আসে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নাম।
এমনকি একই অডিও রেকর্ডে উঠে আসে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদের নামও। সেই বিতর্ক ঘুচতে না ঘুচতেই নতুন করে বিতর্কে পরেছেন তিনি। এবার অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ এই নেতার বিরুদ্ধে।
এর প্রতিবাদে সোমবার বিকালে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ওয়ার্ড বিএনপির নেতাকর্মীরা।
এসময় তারা বিএনপি নেতা মীর জাহিদুল কবির জাহিদের কুশপুত্তলিকায় জুতা এবং ঝাড়–র মালা ও কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। এর আগে রোববার রাতে দলীয় কার্যালয়ে চেয়ার ভাঙচুর ও মহানগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম রিপনকে লাঞ্ছিত করেন পদবঞ্চিত নেতারা।
এদিকে, শুধু রোববারের কমিটি নিয়েই বিরোধ নয়, ইতিপূর্বে আরও ২৩টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন নিয়ে একই বিতর্কে পড়তে হয়েছিল মহানগর বিএনপিকে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে কমিটি গঠন নিয়ে বাণিজ্য এবং একেরপর এক অভিযোগের পরেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। এমনকি হচ্ছে না অভিযোগের কোন তদন্তও।
অভিযোগ উঠেছে, বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে থাকা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ম্যানেজ করেই গঠন হচ্ছে জেলা ও মহানগরের অধিনস্ত বিতর্কিত কমিটি। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি অডিও ক্লিপ এমনটাই ইঙ্গিত করছে। আর এ কারণেই অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছে বারবার। এমনটাই অভিযোগ বিএনপির পদবঞ্চিত নেতাদের।
তবে বিএনপির বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলছেন, ‘এই মুহুর্তে বিএনপির লক্ষ্য একটাই তা হলো সরকার পতনের আন্দোলন। কমিটিতে কে আসলো না আসলো সেটা এই মুহুর্তে দেখার বিষয় না। তবে অভিযোগ গুরুতর হলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিলকিছ আক্তার জাহান শিরিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত রোববার রাতে নগরীর চারটি ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে মহানগর বিএনপি। এরমধ্যে নগরীর ২নং ওয়ার্ডে সামসুল আলম টুটুলকে আহ্বায়ক ও কাজী আরফুজ্জামানকে সদস্য সচিব এবং হানিফুল ইসলাম সুমনকে সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক করে ২৩ সদস্যবিশিষ্ট, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আহ্বায়ক মাসুদ হাওলাদার ও মো. শহিদুল ইসলাম বাবুলকে সদস্য সচিব করে ৩৭ বিশিষ্ট, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে সাগর উদ্দিন মন্টিকে আহ্বায়ক ও আরমান সিকদান নুন্নাকে সদস্য সচিব করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে মাস্তফা মিয়াকে আহ্বায়ক ও জিয়াউল হক মাসুমকে সদস্য সচিব করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়।
রোববার রাতে জেলা ও মহানগর বিএনপি কার্যালয়ে চারটি ওয়ার্ডের কমিটির চিঠি সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের নেতাদের হাতে তুলে দেন মহানগর বিএনপির সদস্য ও দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাহিদুর রহমান রিপন। ২ নং ওয়ার্ডের কমিটি ঘোষণার পর পরই উত্তেজিত হয়ে উঠেন ওই ওয়ার্ডের পদবঞ্ছিত নেতারা।
এক পর্যায় ২ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পাওয়া হানিফুল ইসলাম সুমন উত্তেজিত হয়ে বিএনপি কার্যালয়ে চেয়ার ভাঙচুর এবং দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাহিদুর রহমান রিপনকে মারধর করতে এগিয়ে যান। পরে উপস্থিত অন্যান্য নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এদিকে, ‘সোমবার বিকালে একই ওয়ার্ডের পদবঞ্ছিত নেতাকর্মীরা বিতর্কিত কমিটি বাতিলের দাবিতে নগরীর সদর রোডে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এসময় তারা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদের কুশপুত্তলিকায় ঝাড়– এবং জুতার মালা দিয়ে বিভিন্ন স্লোগান এবং পরে দলীয় কার্যালয়ের সামনে কুশপুত্তলিকা দাহ করেন নেতাকর্মীরা।
এসময় নেতারা বলেন, ‘ওয়ার্ড কমিটি গঠনে মোটা অংকের বাণিজ্য করেছেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। তারা কমিটিতে ত্যাগি নেতাদের অমূল্যায়ন করেছে। এমনকি যারা বিএনপির দুঃসময়ে আন্দোলন সংগ্রাম এবং হামলা মামলার শিকার হয়েছে তাদেরকে কমিটিতে পদ দেয়া হয়নি। বর্তমান মহানগর কমিটি অর্থ ছাড়া কোন কমিটি দেননা বলে দাবি পদবঞ্ছিত নেতাদের।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদের ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বরে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক বলেন, ‘২ নম্বর ওয়ার্ডের যেই ব্যক্তি দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুরসহ বিক্ষোভ করেছে সে আহ্বায়ক পদ দাবি করেছিলেন। কিন্তু সে বিষয়ে সবার আপত্তি থাকায় তাকে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। এ কারণে সে এমন সংগঠন বিরোধী কর্মকাণ্ড করেছে। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিপূর্বে বরিশাল মহানগর বিএনপি ২৩টি ওয়ার্ডে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে। এসব কমিটি নিয়েও পূর্বে অভিযোগ তোলেন পদবঞ্ছিত নেতারা। তারা মহানগর বিএনপির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও করেন।
অপরদিকে, মহানগর ছাড়াও ইতিপূর্বে উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির অধিনস্ত কমিটি নিয়েও অভিযোগ তোলেন পদবঞ্ছিত নেতারা। এ নিয়ে বিভিন্ন উপজেলায় জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল এবং সংবাদ সম্মেলনও করেন তারা।
তাছাড়া সম্প্রতি বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়। ওই ভিডিতে আহ্বায়ক পদের জন্য ৫০ লাখ টাকা লেনদেনের কথা শোনা যায়। যে টাকা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মুজিবুর রহমান নান্টু, সদস্য সচিব আক্তার হোসেন মেবুল, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ, দক্ষিণ জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক এইচএম তসলিম এবং বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় কমিটির একজন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ভাগবাটোয়ারা করেছে বলে অডিওতে শোনা যায়।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে কেন্দ্রীয় কমিটির বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিছ আক্তার জাহান শিরিন বলেন, ‘যেকোন কমিটির পক্ষে বিপক্ষে মতামত থাকে। সে জন্য অভিযোগ দেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু কমিটির বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর অসাংগঠনিক কার্যক্রম বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কমিটি নিয়ে জেলা ও মহানগর নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেত্রী বলেন, ‘বিএনপির এখন একই আন্দোলন তা হলো সরকার বিরোধী আন্দোলন। প্রতি সপ্তাহেই আমাদের আন্দোলন বিরোধী কর্মসূচি থাকে। তার মধ্যেই আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রমও পরিচালনা করে থাকি।
তিনি বলেন, ‘ইতিপূর্বে দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে অভিযোগ উঠে। অভিযোগের সত্যতা থাকায় সেই কমিটি ভেঙে দেয়া হয়েছে। আবার বরিশাল সদর উপজেলা এবং বাকেরগঞ্জ উপজেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি করা হয়েছে। অভিযোগ গুরুতর হলে অবশ্যই আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন মহানগর কমিটি নিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে সে জন্যও সাংগঠনিক ব্যবস্থা হবে। তবে সেটা শুধুমাত্র একপক্ষের বিরুদ্ধে নয়, উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এইচকেআর