‘স্বপ্ন দেখি, একদিন আমরাও ঘুরে দাঁড়াবো’
---বিপ্লব রায়
বরিশালের গুরু কবরী হিজড়ার অধীনে ৬০ জন হিজড়ার বসবাস। এর মধ্যে ১০-১১ জন থাকেন রসুলপুর বস্তি এলাকায়। বাকিরা পলাশপুরসহ বিভিন্ন জায়গায়। অতি মানবেতর জীবন যাপন তাদের। দু’মুঠো অন্ন যোগাতে রোজ ভিক্ষায় বের হন তারা।
এই ঢোলক বাজিয়ে কখনো দোকানে দোকানে আবার কখনো পার্কে গিয়ে মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা নেন এই হিজড়ারা। কেউ টাকা দিতে না চাইলে নিরবে চলে যান। অথচ এই ভিক্ষাবৃত্তি তাদের ভালো লাগে না।
রসুলপুর ডেরার স্বর্ণা, মেঘলা এরা ব্যক্তিগত জীবনে একেকজন মমতাময়ী মানুষ। কাছে গিয়ে তাদের জীবনের গল্প শুনলে চোখে জল ছল ছল করে। কিন্তু তাদের কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, তাদের দেখলেই ধূর ধূর করে তাড়িয়ে দেওয়াই স্বভাব আমাদের।
কারণ, হিজড়াদেরকে দেখলেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ঘৃণাও করি। কিন্তু কেউ ভাবি না, এরা অন্যগ্রহের কেউ নয়। এরাও আমাদেরই মতো কোনো পরিবারের সন্তান। আমাদের এই সামাজিক চাপে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তারা। এখন এই মানুষগুলো লক্ষ্যহীন এক জীবনের পথিক।
তবে তারাও স্বপ্ন দেখেন দিগন্ত জোড়া। তারাও একবার সুযোগ পেলে পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে চান আকাশজুড়ে। স্বপ্ন দেখেন, একদিন হিজড়া শিশুটিও সবার সঙ্গে মিশে স্কুলে যাবে, গান গাইবে। ছবি আঁকবে। জীবন সাজাবে বাঁধাহীন হয়ে।
স্বর্ণার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান তিনি। জন্মের পর ছোটবেলায় ভালোই কাটছিল তার। কিন্তু যখন বড় হতে লাগলেন, শারীরিক ও আচার আচরণে পরিবর্তন আসতে লাগলো। তখন পরিবারের চেয়ে স্কুলের সহপাঠী, শিক্ষক এবং প্রতিবেশিদের অমানসিক আচরণ শুরু হলো। ধীরে ধীরে তার ওপর বাড়তে থাকে মানসিক চাপ। পরিবারকে রাখা হয় একঘরে করে। এভাবে ধীরে ধীরে স্বর্ণা হয়ে ওঠেন এক জীবন্ত লাশ!
এরপর একদিন কাউকে না জানিয়ে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি জমাতে হয় তাকেও। ছিন্নমূল হয়ে শহরের রাস্তাঘাট, লঞ্চস্টেশন, রেলস্টেশন বিভিন্ন জায়গায় খেয়ে না খেয়ে রাত কাটাতে হয় স্বর্ণাকে। শুনতে হয় রাতের হায়েনাদের কুপ্রস্তাব। এভাবে ভাসতে ভাসতে একদিন আশ্রয় জোটে রসুলপুরের কবরী হিজড়ার ডেরায়।
কিন্তু এখানে শুরু হয় আরেক নতুন জীবনের লড়াই। ঢোল নিয়ে ভিক্ষার জীবন। ভিক্ষা কিংবা ঢোলে না গেলে (ঢোল হচ্ছে- কোথাও নতুন শিশুর জন্ম ও বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢোল বাজিয়ে নাচ গান করা) জীবন চলবে না। তাই সাতকূলের মান ভুলে নিজেকে ডোবাতে হয়েছে এই ছিন্নমূল জীবনে।
এখানে শুধু স্বর্ণা নয়। মেঘলা, কাজলীসহ অন্যদের জীবনের গল্পগুলো সব এরকমই। জীবন তাদের কাছে কখনোই উপভোগের নয়। বঞ্চনা আর সংগ্রামের। কিন্তু তাদের প্রশ্ন একটাই, এই সমাজ যদি নিজেদেরকে শিক্ষিত, সভ্য দাবি করে- তবে আমাদেরকে কেন একবারও বোঝে না? আমাদেরকে কেন আমাদের বাড়িতেও থাকতে দেয় না? আমাদের জন্য কেন শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি হয় না? আমাদের কেন হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে চায় না? আমাদের কেন এভাবে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করতে হয়? এসব প্রশ্নের জবাব চান তারা।
হিজড়া সদস্যরা আক্ষেপ করে বলেন, প্রশাসন তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। তারা বলেন, তাদেরকে সবাই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখছেন। কিন্তু তাদের প্রশ্ন, তাদেরকে পিছিয়ে রাখছেন কারা? তাদের কি কোনো দায় নেই? সব দায় আমাদেরই? কারণ, হিজড়া হয়ে জন্ম নিয়ে আজকে এই সমাজের চাপেই ঘরছাড়া হতে হয়েছে এই মানুষগুলোকে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- সম্মানজনক কোনো একটি কাজ করে জীবন কাটানোর মতন একটি সামাজিক বাস্তবতা কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি? আমরা কি এই সমাজে নিশ্চিত করতে পেরেছি হিজড়াদের সমানাধিকার? হিজড়া পরিচয়ে কোনো শিশু কি আজো স্কুলে যেতে পারবে? কোনো পরিবার কি আজো তার সন্তানকে হিজড়া হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে? না। পারবে না। দেবে না। দেয় না। এই যে লোকলজ্জার সংস্কৃতি, এটি নিয়ে ভাবতে হবে।
নিন্দা আর ঘৃণার সমাজ না বদলালে এক হিজড়া কিশোর ভয়-লজ্জা-আড়ষ্টতা ও হীনমন্যতা নিয়ে বড় হবে। নিজেকে ছেলে বা মেয়ে বলে সমাজে একটা ছদ্ম পরিচয় দিয়ে সে যখন বেড়ে উঠবে, তখন তার মনের মধ্যে জমা হবে দুঃখ-বঞ্চনা। ফলে, সে কিছুতেই নিজেকে মূল জনস্রোতের অংশ মনে করতে পারবে না। তাই তো কথিত এই লোকলজ্জার ভয়ে পরিবারও হিজড়া সন্তানকে 'দায়' মনে করতে বাধ্য হয়। অতএব পরিবার থেকে পালিয়েই যেন তাদের মুক্তি।
এজন্য নির্ভার জীবনের আশায় হিজড়ারা খুঁজে নেয় আলাদা সমাজ। নেয় গুরু মায়ের কাছে দীক্ষা। রপ্ত করতে থাকে হাতে তালি বাজিয়ে, কোমর দুলিয়ে, মুখে চটকদার মেকআপ মেখে নাচ-গানের তালিম। অর্থাৎ, বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়েই অনেক হিজড়া নামেন যৌনকর্ম ও চাঁদাবাজির পেশায়। পরে তাদেরকে অপরাধী হিসেবেই সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তাদের পেছনের গল্প আর কেউ জানে না। জানতেও চায় না!
রসুলপুর ডেরার সদস্য মেঘলা জানান, এক কষ্টের জীবন নিয়ে জন্ম আমাদের। তাই এ জীবন তো বয়ে বেড়াতেই হবে। তবে স্বপ্ন দেখি, একদিন এই মানুষ বদলাবে। সমাজ বদলাবে। জীবনও বদলাবে। সেদিন আমার মতো অসহায় হিজড়ারাও পরিবারেরই অংশ হয়ে বাঁচবে। হয়তো সেদিন বেশি কাছে নয়। হয়তো দূরেও নয়।
বেলা অনেক গড়িয়েছে। তাই হিজড়াদের আর অবহেলা নয়। বরং তাদের জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। শুধু রাষ্ট্রই নয়, বেসরকারি ভাবেও তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো সম্ভব। এজন্য আমাদের সবাইর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে আগে।