‘হাবিব স্যার’ আমার পিতা


আব্বা শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি। ছিলেন ইউপি সদস্য। তিনি ভালো জারি লিখতেন। কিন্তু শিক্ষক পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন।
মাইনে পেতেন কম। জমি, চাষাবাদ দিয়ে যে টাকা আসতো তা দিয়েই মূলত সংসার চলতো। যুদ্ধের পর যখন সামরিক বাহিনী পুর্নগঠন হচ্ছিল। তখন অনেকেই যোগ দিলেন বাংলাদেশ আর্মিতে। মা বলেছেন, তোর আব্বারও প্রস্তাব এসেছিল আর্মির বড় পদে চাকরির জন্য। কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারন শিক্ষকতা তিনি ছাড়তে পারবেন না।
আব্বার ইচ্ছা ছিল আমরা চার ভাইবোন যেন শিক্ষিত হই-উচ্চশিক্ষা গ্রহন করি। চাকরির প্রসঙ্গ সবসময়ে তার কাছে তোলা থাকতো। তিনি স্বপ্ন দেখতেন আমরা শিক্ষিত হবো। জনে জনে বলে বেড়াতেন, তার সন্তানদের শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্নের কথা। তার স্বপ্নে অমুক চাকরি, তমুক চাকরি করবো এমন উল্লেখ থাকতো না। আমরা যেন মানুষের মত মানুষ হই, আমাদের দ্বারা ক্ষুদ্র হলেও যেন দেশের উপকার হয় সেই প্রত্যাশা করতেন।
শুধু যে আমরা তেমন না ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীদের সমান চোখে দেখতেন। ফলে আমরা কিছুটা অসন্তোষ হতাম, কেন আব্বা সবাইকে আমাদের চোখে দেখেন? ধরুন খাঁ বাড়ির একজনের পরীক্ষার ফি নেই। পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ। খবর পেয়ে সেই ছেলেকে পরীক্ষা দিতে আসতে বলে হেড স্যারের কাছে গিয়ে জানাতেন ফি তিনি পরিশোধ করবেন। প্রতি পরীক্ষার আগে একেএকে করে এভাবে দীর্ঘ তালিকা হতো। এই খবর আবার প্রতিদিন ঘরে এসে মাকে বলতাম, আব্বা অমুকের ফি দিয়ে দিয়েছে। আব্বা অমুকের বেতনের টাকা দিয়ে দিয়েছে। আব্বা অমুককে স্কুল ড্রেস বানিয়ে দিয়েছে।
মা বলতো, তোর আব্বা ওইরকম। অনেক নিষেধ করেছি। কাজ হয়নি। এখন যা খুশি করুক।
অর্থাৎ আম্মা একসময়ে আব্বার ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ করতেন না। কারন তিনি জানতেন, যত অভাবই হোক-কেউ তার কাছে সাহায্য চাইলে তা তিনি কর্জ করে হলেও করবেন।
আব্বা তখন দ্বিতীয় দফায় ইউপি মেম্বার। আমাদের ওয়ার্ডের একটি রাস্তায় কালভার্টের খুব দরকার। বর্ষার পানিতে রাস্তা ভেঙে গেছে। বাসিন্দা এবং শিক্ষার্থীরা চলাচল করতে পারছিল না। খবর এলো আব্বার কাছে। চেয়ারম্যান তখন জামায়াতের তোফাজ্জেল হোসেন। বিষয়টি জানালেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের সভাপতিকে জামায়াতের চেয়ারম্যান কোন কাজ দিবেন না সেটা জানা কথা। ফলে আথালে থাকা দুটি গরুর একটি বিক্রি করে দিলেন। সেই গরুটি ছিল আমার পছন্দের। ওই গরুটির পিঠে চড়তাম। ফলে ঘরে লঙ্কাকান্ড বাঁধিয়ে দিলাম। অনেক সংগ্রাম করেও গরু বিক্রি ঠেকাতে পারিনি।
তারও মাসখানেক পরে আব্বা আমাকে কোলে করে মাটির রাস্তার কাদা ডিঙ্গিয়ে একটি কালভার্ট দেখাতে নিয়ে গেলেন। কালভার্ট দেখলাম। তখন আব্বা জানালেন, তোমার করে দেওয়া কালভার্টটি দিয়ে এই গ্রামের মানুষের হাটার ব্যবস্থা হয়েছে। তারা তোমাকে অনেক দোয়া করেন।
প্রথমে বুঝতে পারিনি না আব্বা কী বলছেন। পরে আরো স্পষ্ট করলেন, আমাদের দুটি গরুতে দুধ দেয়। একটির দুধ হলেই হয়। বাকি একটি বিক্রি করে মানুষের উপকার হলে ক্ষতি কি? বরংছ আল্লাহ খুশি হবেন। তিনি জানালেন, আমি যে গরুটির পিঠে চড়তাম সেটি বিক্রি করে এই কালভার্টটি করা হয়েছে।
অনুভব করলাম আমার বুকের ছাতি বড় হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে কাঁদলেও, আব্বার কোলে চড়ে কালভার্ট দেখতে যাওয়ার পরে মনে হলোÑবাকি গরুটি বিক্রি করে দিলেও আমি কোন প্রতিবাদ করবো না।
৪ঠা বৈশাখ যখন হাওলাদার বাড়ির মাঠে থৌল বা মেলা হতো তখন আমাদের বাড়িতে লাইন হতো। আমার বন্ধুরা মেলার খরচ ২০টাকা পেলে আমিও পেতাম ২০ টাকা। কখনোই তিনি ২১ টাকা দিতেন না। ওই সময়ে ২০ টাকার দাম ছিল শত টাকার সমান। যদিও মায়ের কাছ থেকে বেশি নিয়ে চলে যেতাম থৌলে। কিন্তু আব্বার এমন নিয়মাবলীতে দিনে দিনে আমার মধ্যে মানসিকতা গড়ে উঠেলোÑআমার ক্লাসের বন্ধুরা এবং আমি; এরমধ্যে কোন পার্থক্য নেই। মানুষমাত্রই সমান।
৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস। কোন দিবস হিসেবে নয়, আব্বাতো আমাদের পরিবারের কাছে চির জীবন্ত। জীবন্ত আদর্শ। অন্তত শিক্ষক শব্দটির সাথে স্মৃতি ভেসে এলো মনে।
পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা সাপলেজা ইউনিয়নের নলী ভীম চন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক ছিলেন আমার আব্বা জাকির হোসেন। তার আরেকটি ডাক নাম ছিল হাবিব। এলাকায় জাকির হোসেনের চেয়ে ‘হাবিব স্যার’ বলেই সবাই চেনেন। দলিল-দস্তবেজে হয়তো জানেন জাকির হোসেন নামে। ২০২০ সালের ২৬ এপ্রিল রাতে বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আব্বা দীর্ঘদিন কিডনি, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন।
এসএমএইচ
