ঢাকা বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫

Motobad news

দীর্ঘ আঠারো মাস পর গ্রামে ফিরে দেখেন ঘর-বাড়ি মাটির সাথে মিশে গেছে

দীর্ঘ আঠারো মাস পর গ্রামে ফিরে দেখেন ঘর-বাড়ি মাটির সাথে মিশে গেছে
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

দীর্ঘ আঠারো মাস পরে গাঁয়ে ফিরেছেন তাঁরা। ফিরে দেখেন তাঁদের ঘর - বাড়ি, দালান - কোঠা ভেঙে মাটির সাথে মিশে গেছে। ঘরে থাকা আসবাবপত্র গুলোর কোন চিহৃই নেই। বাড়ির চারিপাশের মোটা গাছ গুলো আর নেই। যতদুর চোখ যায় শুধু লতাপাতা ঘেরা জঙ্গল আর জঙ্গল। সাথে শুধু পাখির কিচিরমিচির শব্দ। এযেন যুদ্ধ পরবর্তী বিধ্ববস্ত এক গাঁও।

সভ্য সমাজেও এমন নিষ্ঠুর বর্বর চিত্র কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামে। অথচ আঠারোমাস আগেও এখানে ছিল মানুষের কোলাহল। কাঁচা পাকা কয়েকশত ঘরবাড়ি ও শতশত মানুষের বসবাস।

তবে অনেক দেরিতে হলেও প্রশাসনের সহযোগীতায় তাঁরা আবার গ্রামে ফিরেছেন। জঙ্গল কেটেকুটে পুনরায় আবাসস্থল গড়ার চেষ্টা করছেন। জরাজীর্ণ পরিবেশে শুরু করেছেন বসবাস।

ভুক্তভোগী পরিবার গুলো দাবি করেন, প্রতিপক্ষরা তাঁদের বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। কিন্তু প্রতিপক্ষরা বলেন, ঘটনার পর তিনমাস এলাকায় পুলিশ ছিল। কে বা কাহারা এজঘন্য কাজ করেছে তা তাঁদের জানা নেই।


পুলিশ ও এলাকাবাসী সুত্র জানায়, আধিপত্য বিস্তার, সমাজপতিদের দলাদলি ও উসকানিতে ২০২০ সালের ৩১ শে মার্চ ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে নেহেদ আলী (৬৫) ও বকুল আলী (৫৫) নামের আপন দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এঘটনার পরদিন নিহত নেহেদ আলীর ছেলে নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে ২৮ জনকে আসামী করে কুমারখালী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলা নম্বর ০১, তারিখ ১/৪/২০২০ । মামলায় গ্রেফতার ভয়ে আসামীরা ও ঘটনায় প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার।

পালানোর সুযোগে ইট পাথরের তৈরি পাকা ঘর- বাড়ি থেকে শুরু করে সকল স্থাপনাদি ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরে থাকা সকল প্রকার আসবাবপত্র, কৃষি ফসলাদি, গৃহপালিত পশু- পাখি, সোনার গহনা, নগদ টাকা সহ যাবতীয় সামগ্রী লুটপাট করে নিয়েছে কে বা কাহারা।

শুধু তাই নয়, দিনেদিনে ভাঙা ঘরের ইট, কাঠ ও মাটি পর্যন্ত লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও বড় বড় কাঠের বাগানসহ সকল গাছ ও বাঁশ গুলো কেঁটে নেওয়া হয়েছে।

এবিষয়ে আঠারোমাস পরে গাঁয়ে ফেরা পাহারপুর গ্রামের মৃত হেকমতের ছেলে আলমগীর হোসেন বলেন, ' আমি একটি কোম্পানিতে চাকুরি করতাম। ঘটনার সময় মার্কেটে ছিলাম। মুঠোফোনে জানতে পারি এলাকা জোড়া খুন হয়েছে। পরে সেই খুনের মামলায় আমাকে ১১ নং আসামী করা হয়েছে। '

তিনি আরো বলেন, ' মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে ছিলাম। সেই সুযোগে প্রতিপক্ষের লোকজন পাকা, কাঁচা ঘরবাড়ি গুলো ভেঙে চুরে নিয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে চারশ মেহগুনি গাছে বাগান ছিল। তিনবিঘা জমিতে পুকুর ছিল। সব লুটপাট হয়ে গেছে।'

ওই গ্রামের রুস্তম আলী শেখের স্ত্রী আলেয়া খাতুন বলেন, ' আমরা ঘটনায় জড়িত নয়। তবুও সেদিন রাতে মুখ বাঁধা কিছু লোকজন বাড়িতে হামলা চালিয়ে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার দুইলক্ষ টাকা ও গহণা লুট করে নেয় এবং আমার বিয়ের উপযোগী দুই মেয়ে ও অসুস্থ স্বামীকে বেধরক মারপিট করে তাড়িয়ে দেয়। '

তিনি আরো বলেন, ' আমার দুই ছেলে ঢাকায় চাকুরি করে। এতদিন সেখানে থাকতাম। এখন প্রশাসনের সহযোগীতায় বাড়িতে এসেছি। কিন্তু ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র কিছুই বাড়িতে নেই। তবুও নতুন করে বসবাস শুরু করতে চাই। সরকার যেন আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন।'

এবিষয়ে নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, 'তুচ্ছ ঘটনায় এলাকাতে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।আমরাও চাই প্রকৃত দোষীদের বিচার হোক। কিন্তু যারা নিরপরাধ, নির্দোষ, তারা কেন মামলার আসামী হবে, ভোগান্তি পোহাবে, এলাকা ছাড়া হবে। তাঁরা আরো বলেন, 'একজন অপরাধ করতে পারে, কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা তো অপরাধী নয়, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, পশুপাখি, গাছপালা, বাড়ির আসবাব পত্র তো অপরাধী নয়। '

বুধবার সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ' এক সময় জনাকীর্ণ পাহাড়পুর গ্রামের অর্ধেক অংশ লতাপাতায় জঙ্গলে ভরা। শুধু ঘরবাড়ি গুলো ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। ফেরত আসা পরিবার গুলোর কেউ আঙিনায় স্প্রে করছে। কেউ বাঁশ কাঁটছে। কেউ আবার জরাজীর্ণ থাকার ঘর তৈরি করছে।

এছাড়াও বেশকিছু তাবু বা কুড়ে ঘরও দেখা যায়। পুলিশের টহল গাড়ি ও দুইজন পুলিশ সদস্যকে দাঁয়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।

মামলার ২৩ নং আসামী আসামী মাসুদ রানার স্ত্রী বলেন, ' আমার স্বামী ময়মনসিংহে চাকুরি করে। সেখানেই আমরা থাকি। ঘটনার দিন সেখানে থেকে মার্ডার মামলার আসামী হয়েছে স্বামী। আর কে বা কাহারা ঘরবাড়ি ভেঙে গাছ গাছালিসহ মালামাল লুট করেছে। '

ভুক্তভোগী আব্দুর রহমান বলেন, ' আমি একজন কৃষক। আটবিঘা জমিতে চাষাবাদ করি। আমি মামলার আসামী নয়, তবুও আমার ঘরবাড়ি ভাঙা হয়েছে। নতুন করে নির্মাণ কাজ শুরু করেছি।'

জোড়া খুন মামলার বাদী বলেন, ' আমার পরিবার শোকাহত। আমরা কারো ঘরবাড়ি ভাঙিনি। লুটপাটও করিনি। ঘটনার পর প্রায় তিনমাস এলাকায় পুলিশ ছিল। ' তিনি আরো বলেন,' আমাদের সাথে সামাজিকভাবে সমাঝোতা না করে হঠাৎ পুলিশ আসামী পক্ষের বাড়ি তুলে দিয়েছে। তৃতীয় পক্ষ কোন সুযোগ নিলে কে এর দায়ভার নেবে?'

কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ' আসামীরা জামিন নিয়ে গ্রামে ফিরেছে। পুলিশ আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে।' তিনি আরো বলেন, ' ঘটনা আমি যোগদানের পূর্বে। তাই কে কি করেছে জানা নেই। তবে মিলেমিশে বসবাসের জন্য উভয় পক্ষ্যকে ডাকা হয়েছে।'

 

রবিউল ইসলাম হৃদয় /এইচকেআর

 


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন