ঢাকা রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

Motobad news
এমভি অভিযান-১০ ট্রাজেডি

দাফনে সহায়তাকারীরা ‘অস্বাভাবিক’ হয়ে পড়ছেন পোড়া লাশ দেখে

দাফনে সহায়তাকারীরা ‘অস্বাভাবিক’ হয়ে পড়ছেন পোড়া লাশ দেখে
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

আগুনে পুড়ে যাওয়া লাশের বিভৎসতা দেখে অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে জীবনযাপন বলে জানিয়েছেন দাফনে সহায়তাকারীরা। তাঁরা জানান অভিযান-১০ লঞ্চের আগুনে পুড়ে নিহত ব্যাক্তিদের অনেকের লাশের ওজন চার-পাঁচ কেজিও ছিল না। আর যারা সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়েছেন এবং দগ্ধ হয়ে মানুষ পুড়ে যেতে দেখেছেন তারা কতদিনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যেকোন বিভৎসতার সীমা অতিক্রম করেছিল ওই রাত বলে মনে করেন দাফনসহায়তাকারীরা। 


তেমনি একজন সহায়তাকারী বরগুনা পুলিশ লাইন্স এলাকার যুবক আব্দুল্লাহ আল মামুন। স্থানীয় একটি কলেজে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তিনি। মামুন বলেন, কিছু লাশ কবরে নামানোর সময়ে মনে হচ্ছিল যেন কয়েক কিছু কয়লা নামিয়ে রাখছি। 


বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালী গণকবরে ২৩ টি লাশের মধ্যে তিন থেকে চারটি লাশের আকৃতি ছিল। বাকি লাশের কোন আকৃতি ছিল না। আমি যদি আরো স্পষ্ট করে বলি যে, আকৃতি বলতে একটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কালও ছিল না। উল্লেখ করেন আব্দুল্লাহ আল মামুন।

অজ্ঞাত লাশের জানাজায় যোগ দিতে গিয়ে নিজেকে দাফনকার্যে জড়িয়ে ফেলা এই যুবক বলেন, একটি লাশবহনকারী কফিনের নিচের কাঠ ছুটে গিয়েছিল। সেটি মেরামত করতে গিয়ে কফিন ধরি। এরপর মন থেকে টান দেয় যেন এই কাজে যুক্ত থাকি। ধরুন এখানে যাদের দাফন করা হয়েছে, তাদের যদি স্বজনরা শনাক্ত করতে পারতো তাহলে আরো ভালোভাবে দাফন হতো। এমন পরিণতি আমারও হতে পারতো।

আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, দাফনের পর এখানে আমি আর আসতে চাইনি। কারন লাশের আকৃতি এমন ছিল যে আমি তাদের রক্তের আত্মীয় না হয়েও আমার বুক কেঁপে উঠছে। আর যার সাথে এমন ঘটনা বা যাদের স্বজনরা এমন পরিণতির শিকার হয়েছেন তাদের অবস্থাটা কি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। 

লঞ্চের মালিক একজন মানুষ। আর যারা পুড়ে মারা গেছেন তারাও মানুষ। সবারই অনুভূতি আছে। লঞ্চের মালিক যদি লঞ্চে থাকতো সেওতো পুড়ে মারা যেত। এজন্য নিজের নিরাপত্তার জন্য হলেও সকল পরিবহনে যাত্রীদের নিরাপত্তা বাড়ানো উচিত। জ্বালানী তেলের মূল্য বেড়েছে বিধায় পরিবহন মালিকরা ভাড়া বাড়িয়েছে, তাহলে যাত্রী নিরাপত্তা বাড়ানো হবে না কেন? প্রশ্ন করেন এই স্বেচ্ছাসেবী। 


আরেক শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান সৈকত বরগুনা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত আছেন রোভার স্কাউটে। তিনিও নিজ হাতে লাশ কফিন থেকে বের করা, গণকবরে নামানোর কাজ করেছেন। অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিতে বলেন, হাসপাতালে লাশগুলো প্যাকেটে এসেছে। যেন বারবার সেই প্যাকেটের মুখ খুলতে না হয় এজন্য প্রতিটি লাশের ছবি মোবাইলে তুলেছি। সেই ছবিগুলো প্রিন্ট করে কফিনের গায়ে লাগানো হয়, যদি কোন স্বজন লাশ শনাক্ত করতে পারেন।

যতগুলো লাশ নিয়ে আসা হয়েছিল তারমধ্যে ৭/৮টি লাশ মোটামুটি মানুষের আকৃতির ছিল। সেগুলো তাদের স্বজনরা শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন। এছাড়া যতগুলো লাশ ছিল সেগুলোর বর্ণনা করার ভাষা নেই উল্লেখ করে বলেন, এত নির্মমভাবে ওই মানুষগুলো পুড়েছে যা দেখে বলা মুশকিল এগুলো মানুষ কিনা। একেবারে কয়লা। তারা পুরুষ নাকি মহিলা সেটা বোঝারও কোন অবস্থা ছিল না। 
সোহান বলেন, অনেকেই কফিনের ওপরের ছবি দেখেছেন। কিন্তু তারা যদি সরাসরি লাশগুলো চোখ দিয়ে দেখতেন তাহলে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। এরমধ্যে একজোড়া লাশ ছিল তাদের আলাদা করার কোন অবস্থা ছিল না। কবরের প্রথম সারির প্রথম কবরে তাদের দাফন দেওয়া হয়েছে। সেই লাশদুটি আলাদা করার কোন উপায় ছিল না। তারা এমনভাবে জড়িয়ে ছিলেন। লাশ দুটি ছিল মা ও সন্তানের। 

সবগুলো লাশ দাফন কার্যক্রমের শেষ সময় পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন উল্লেখ করে এই স্বেচ্ছাসেবক বলেন, যার স্বজন হারিয়েছে তিনিই বোঝেন এই কষ্ট প্রকাশের ভাষা পৃথিবীতে আবিস্কার হয়নি। আমরা যতটুকু কষ্ট পাই সেটিও মর্মান্তিক। 

সোহান বলেন, করুন পরিণতির শিকার এই মানুষগুলোর দাফন করার পর থেকে রাতে আমার ঘুম আসে না। যেন নিজের শরীর থেকে পোড়া গন্ধ আসে বলে বিভ্রম হয়। আমার সবসময়ে খারাপ লাগছে, জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো নিজে তা কখনো কল্পনাও করিনি। 

এই স্বেচ্ছাসেবক বলেন, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কখনোই চাইবো না একজন মানুষের এমন মৃত্যু হোক। এমন মর্মান্তিক মৃত্যু যেন শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বে যেন কোথাও না হয়। 

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৪৫ জনের মৃতদেহ গ্রহন করেছে বরগুনা জেলা প্রশাসক। এরমধ্যে ২৩ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি বলে তাদের গণকবরে দাফন করা হয়েছে। বাকিদের শনাক্ত করে তাদের স্বজনরা নিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত নিহতদের ২৫ হাজার টাকা সহায়তা করা হয়েছে। পরিচয় শনাক্তের জন্য এখন পর্যন্ত ৪৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকি আরো দুজনের নমুনা সংগ্রহ করা হবে। 

প্রসঙ্গত, শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) রাত তিনটার দিকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা নদী অতিক্রমকালে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে পুড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ২৩ জনের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালীতে ২১টি কবরে ২৩ জনকে গণকবর দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বরগুনা, ঝালকাঠি ও ঢাকায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলায় লঞ্চের মালিকসহ মোট ৫ জন কারাগারে রয়েছেন। 
 

 

 

 


এসএমএইচ
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন