ঢাকা শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Motobad news

জনবহুল স্থানে ব্যাটারি কারখানা, বিষাক্ত সিসার ঝুঁকিতে মানুষ

জনবহুল স্থানে ব্যাটারি কারখানা, বিষাক্ত সিসার ঝুঁকিতে মানুষ
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

এক সময় ছিল টেক্সটাইল মিলস। এখন সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যাটারির কাঁচামাল সিসা উৎপাদনের কারখানা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর ড্রিম হলিডে পার্কের ঠিক উল্টো পাশেই জেনিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডে উৎপাদন হচ্ছে এই সিসা। বিগত দেড় বছর ধরে চীনা নাগরিকরা এ কারখানা পরিচালনা করছেন। কিন্তু সরকারি কোনো দপ্তরের অনুমোদন তাদের নেই।

সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কারখানাজুড়ে বসানো হয়েছে সিসার বার তৈরির মেশিন। সেসব মেশিনে উৎপাদিত সিসার বার, কাঁচামাল ও কয়লা কারখানার পুরো শেড জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক কোনো নিরাপত্তা সামগ্রী ছাড়াই কাজ করছেন বিষাক্ত এ কারখানায়। সংবাদকর্মীরা যেতেই তারা কাজ বন্ধ করে দেন।

কারখানায় সংবাদকর্মী প্রবেশের সংবাদে ছুটে আসেন এক চীনা নাগরিক। ইন ওয়েন উই নামে ওই চীনা নাগরিক নিজেকে কারখানার চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দেন। এসময় তার সঙ্গে থাকা দোভাষী আল-আমিন জানান, কারখানাটি এখনও চালু করা হয়নি। ট্রায়াল হিসেবে কিছু সিসা উৎপাদন করা হচ্ছে, যা বিভিন্ন ব্যাটারি কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সিসা পোড়ানোয় দূষিত ধোঁয়া আশপাশের পরিবেশের ক্ষতি করছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের ইটিপি আছে, এখনও চালু করা হয়নি। এরই মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে কারখানাটি উৎপাদনে যাবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কারখানাটি পুরোদমে চালানো হয়। এরই মধ্যে কারখানায় সিসা পোড়ানোর বিষাক্ত ধোঁয়ায় কারখানার নারিকেল ও আম গাছের পাতা পুড়ে গেছে। এ কথাটির সত্যতা মিলল গাছের দিকে তাকাতেই।

কারখানার পেছনে বসবাস করা আফিয়া আক্তার বলেন, রাতে সিসা কারখানার ধোঁয়া ছাড়া হয়। এ কারণে এ বছর আম গাছে মুকুল আসেনি, অনেক গাছের পাতা পুড়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ায় আমাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। শুনেছি, এ ধোঁয়া নাকি বিষাক্ত। আমাদের শরীরে রোগ হবে। কিন্তু প্রশাসন যদি এসব বন্ধ না করে, আমরা কীভাবে বাঁচব?

শুধু এ কারখানা নয়, শিল্পনগরী নরসিংদীতে অন্তত এক ডজন ব্যাটারি তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে; যার অধিকাংশেরই পরিবেশ অধিপ্তরের ছাড়পত্র নেই। আর এসব কারখানার প্রায় সবগুলোর মালিক চীনা নাগরিকরা।  

শ্রমিকরা জানান, চীনা নাগরিকদের তত্ত্বাবধানে কারখানায় প্রায় শতাধিক শ্রমিক রয়েছেন। কারখানায় প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার ব্যাটারি তৈরি করা হয়। যা দেশের বিভিন্ন স্থানের দোকানে সরবরাহ করা হয়।

নরসিংদী জেলা সিভিল সার্জন ডা. নুরুল ইসলাম বলেন, ব্যাটারি তৈরির কারখানায় পোড়ানো সিসা প্রথমে মাটিকে আক্রান্ত করে। পরে তা বিভিন্নভাবে আমাদের মানবদেহে প্রবেশ করে, যা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে শিশুদের ওপর। শিশুরা সিসার বিষে আক্রান্ত হলে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়, পড়াশোনায় তাদের দক্ষতা থাকে না, তাদের বুদ্ধিমত্তাও লোপ পায়। এর ফলে প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের মানসিক বিকৃতি, রক্তশূন্যতা, কিডনি ফেইলর ও মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন হতে পারে। হতে পারে ত্বকের নানা রোগ। আর সিসার বর্জ্য কৃষি ক্ষেতে পড়ে, তা শাক-সবজির মাধ্যমে আমাদের শরীরের প্রবেশ করছে। তাই যত্রতত্র ব্যাটারি কারখানার অনুমোদন না দিয়ে সরকারের পরিবেশ দপ্তরের নিয়মনীতি মেনে বৃহৎ কোনো প্রতিষ্ঠানকে কারখানার অনুমতি দিলে পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র্য ও মানবদেহের ক্ষতির হুমকি কমে আসবে। 

নরসিংদীর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহম্মদ হাফিজুর রহমান জানান, ব্যাটারি কারখানা পরিবেশের ক্ষতি করছে। কোনো কারখানাই এ পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধ্যতামূলক ছাড়পত্র নেয়নি। এরই মধ্যে অবৈধ ব্যাটারি কারখানার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাটারি কারখানাগুলো কোনোভাবেই চালাতে দেওয়া ঠিক হবে না।

নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান বলেন, পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যাটারি কারখানাগুলোর বিষয়ে জেলার মাসিক সমন্বয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সেখানে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যাটারি কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে।


এমইউআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন