ঢাকা শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩

Motobad news

তন্ময়ের আত্মহনন, প্রধান শিক্ষক ভালো আছেন তো?

তন্ময়ের আত্মহনন, প্রধান শিক্ষক ভালো আছেন তো?
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন


---বিপ্লব রায়, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মতবাদ

পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলায় ফি পরিশোধ না করে গত ৯ অক্টোবর এসএসসি’র টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিল আরজবেগী এস এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র তন্ময় চক্রবর্তী। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেয়নি কক্ষ পরিদর্শক শিক্ষক মরিয়ম বেগম। তিনি তন্ময়কে সাফ জানিয়ে দেন, ফি বকেয়া থাকায় পরীক্ষা দিতে পারবেনা। নিরূপায় হয়ে প্রধান শিক্ষক কাওসার হোসেনের কাছে ওই ছাত্র গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহনের অনুমতির জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু অনুরোধ কি শুনবেন তিনি? বরং সহপাঠীদের সামনে নেশাখোর বলে গালমন্দ ও এক পর্যায়ে বেত্রাঘাত করতেও দ্বিধা করেননি শিক্ষক।

এই লজ্জা, ঘৃণা ও অভিমানে বাজার থেকে এক ধরনের ওষুধ কিনে অতিমাত্রায় খেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন তন্ময় (১৫)। এই তন্ময়ের বাবা গোপাল চক্রবর্তী ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রয়াত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। তন্ময় তাঁর বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন।

এ নিয়ে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক কাওসার হোসেনের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। নেই সমবেদনাও। একই বিদ্যালয়ের একজন সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের ছেলের মৃত্যুর দায় তার কাঁধে! ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই তার। বরং সাংবাদিকদের কাছে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তন্ময়কে মারধর তো দূরের কথা, গালমন্দও করা হয়নি।

জানি কাওসার সাহেব, এছাড়া আপনার কোনো বক্তব্য থাকার কথা না। বর্তমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক শক্ত অবস্থান থাকলে এই তন্ময়দের হত্যার দায়েও কিছু হবে না আপনার। কিন্তু আপনি একজন বাবা। একজন মানুষ। মনুষ্যত্ব কতটুক ুআছে, সে দায় অবশ্য আপনি তন্ময়কে দিয়েই দিয়েছেন। এরআগেও কত তন্ময়ের হৃদয়ে ক্ষত যুক্ত করেছেন, তার হিসেব নাই। কারণ, প্রধান শিক্ষক হতে তো এভাবে বহু শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন যে করেছেন, তা বলা বাহুল্য। 

এই ঘটনা আপনি একজনই যে ঘটান, তা নয়। আমার স্কুল জীবনে বহু এমন ঘটনা দেখেছি-বেতন দিতে পারেনি বলে স্কুল থেকে বহু ছাত্রকে বের করে দিয়েছে শিক্ষক। সবার সামনে বেত্রাঘাত করেছে। অপমান-অপদস্ত করেছে। এসব নিয়ে কাউকে কোনদিন প্রতিবাদ করতে দেখিনি। কোনো শিক্ষককে সমব্যথী হতে দেখিনি। আজকাল আরও অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন কৌশলে জিম্মি কওে শিক্ষার্থীদেও কাছ থেকে টাকা চুষে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার নেই। প্রশাসনও এসব জানে। কিন্তু নেই কারো প্রতিক্রিয়াও।

গত ১৭ জুলাই সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে শিক্ষকের এলোপাতাড়ি পিটুনি ও লাথিতে রাজপ্রতাপ দাস (১৫) নামের নবম শ্রেণির এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। এরপর তার লাশ নিয়ে এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয়রা। এ নিয়ে কেউ কোথাও প্রতিবাদ করেছেন শিক্ষকেরা? এমন কোনো ঘটনা গণমাধ্যমে আসেনি। আপনারা আদর্শ শিক্ষকের পতাকা নিয়ে রাজপথে দাবি আদায়ের মিছিল করেন। আপনারা নিজেদের স্বার্থ আদায়ের নামে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। স্কুলে না পড়িয়ে কোচিংয়ে টানতে বাধ্য করেন। স্কুলে টিচার্স ডে নাম করে কোমলমতি শিশুদের কাছ থেকে বেশি টাক নিয়ে। বিনিময়ে ৫ টাকা দামের একটি ওয়েফার (চকলেট জাতীয় খাবার) ধরিয়ে দেন। (সম্প্রতি বরিশালের উদয়ন স্কুলে এই কাজ করেছে)। এছাড়াও নানা সুতোয় টাকা তুলে নেয়া হচ্ছে। এ তো শুধু এমপিও ভুক্ত স্কুলের কথা বলা হলো। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে তো টাকা আর টাকা। ব্যবসা আর ব্যবসা। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। এখান থেকে শেখানোর কথা ছিল নৈতিকতা, মানবতা, মনুষ্যত্ব। কিন্তু কী শেখাচ্ছেন? নিজের কাছে প্রশ্ন করেছেন কখনো? কখনো শিক্ষা নীতি নিয়ে কথা বলেছেন কেউ? শিক্ষার্থীদের পক্ষে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে কিংবা সঠিক কোনো পরামর্শ নিয়ে রাজপথে নেমেছেন কেউ? নামেননি। নেমেছেন নিজেদের দাবি আদায় নিয়ে। কীভাবে স্কুল সরকারি করা যায়, কীভাবে নিজের ভবিষ্যৎ পূর্ণ করা যায়, তা নিয়ে।

কিন্তু কোথাও শিক্ষকের অপমান হলে প্রতিবাদ করেছি আমরা। শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা রাস্তায় নেমেছি। মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে সাম্প্রদায়িক ভাবে নাজেহাল করা হয়েছিল। বিবেকবান মানুষ কেউ চুপ থাকেননি। নারায়ণগঞ্জে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কানধওে ওঠবস করানোর ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে বিশ্বজুড়ে। আমরা শিক্ষকদের এখনো সম্মান জানাতে ভুলিনা। কিন্তু আপনারা সেই কাজ করছেন তো?

এই অপকর্ম শুধু কাওসার হোসেনরা করছেন তা নয়। এই বিষধর ব্যক্তিরা পৌঁছেছে বিশ্ববিদ্যালয়েও। শিক্ষকের অপমান সহ্য করতে না পেরে গত মার্চে আত্মহননের চেষ্টা করেছিলেন এসএম এহসান উল্লাহ ধ্রুব নামের এক ছাত্র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ বিষয়ক উপসম্পাদক। তিনি ২০১৮-১৯ সেশনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী। (কালের কন্ঠ-৩ মার্চ-২০২৩)

আজকাল শিক্ষকতা একটা স্রেফ চাকরি। আয়ের পথ। কিন্তু শিক্ষকতা শুধু আয়ের পথ নয়। এটা মানুষ গড়ার ব্রত। তাই সবাই শিক্ষক হওয়ার যোগ্য নয়। এ পেশা কাওসার হোসেনদের মতো লোকদের জন্য নয়। এভাবে চলতে পারেনা। এ ধরনের ঘটনা বহু ঘটছে প্রতিনিয়ত।

এ বিষয়ে সবার সজাগ হওয়া জরুরি এখনই। নয়তো আরো বহু তন্ময় এভাবে অকালে প্রাণ হারাবে।

আমরা আবার গলা ছেড়ে বলতে চাই কবি লীলা মজুমদারের কবিতা- 
মেঘ কেটে যায় রোদ্দুর ওঠে, আঁধার রাতে জোৎস্না ফোটে। 
সুখ রহেনা পথে পড়ে, সুখ নিতে হয় হাতে গড়ে...।।

(বি দ্র- লেখায় আদর্শবান শিক্ষকদের কেউ মনে আঘাত পেলে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে যারা এ পেশাকে কলঙ্কিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে চলবে)


 


এএস
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন