ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫

Motobad news
ভেজাল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে, চিকিৎসকরা পাচ্ছেন মোটা অংকের কমিশন

বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে কথিত ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’র রমরমা বাণিজ্য

বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে কথিত ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’র রমরমা বাণিজ্য
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

ফুড সাপ্লিমেন্ট বা খাদ্য সম্পূরক, যা স্থানীয়ভাবে ‘কৌটা বা পট কোম্পানির’ ওষুধ হিসেবে পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকি এবং ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে এগুলো না লেখার নির্দেশনা রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের।

অথচ সেই নির্দেশনার বালাই নেই বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে। বরং শিশু থেকে শুরু করে সকল বয়সী রোগীকেই ফুড সাপ্লিমেন্ট ওষুধ হিসেবে সেবন বা গ্রহণের জন্য লিখে দিচ্ছেন কতিপয় চিকিৎসক। ফার্মেসিগুলোতেও বিদেশী ওষুধের নামে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট।

অভিযোগ রয়েছে, রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখে প্রতি মাসে চিকিৎসকরা পাচ্ছেন মোটা অংকের কমিশন। আর বিক্রির জন্যও কমিশন পাচ্ছে বরিশাল সদর বা জেনারেল হাসপাতালের আশপাশের কিছু ফার্মেসি মালিক। তবে এ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং ওষুধ প্রশাসনের তদারকি না থাকায়, ক্ষুব্ধ সচেতন মহল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ী স্থানীয়ভাবে খাদ্য উপাদান দিয়ে ফুড সাপ্লিমেন্ট তৈরি করে ওষুধ নামে প্রকাশ্যে বাজারজাত করছে। নিজেদের তৈরি এসব সাপ্লিমেন্টের প্যাক বা মোড়কে ভারতের বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে কৌশলে ফার্মেসি মালিক এবং কতিপয় চিকিৎসকদের সহায়তায় চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে রোগীদের কাছে।

সূত্র জানিয়েছে, বরিশাল সদর অথবা জেনারেল হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক রোগীর ব্যবস্থাপত্রে প্রতিনিয়ত ভিটামিন এবং ক্যালসিয়াম ওষুধ হিসেবে লিখে দিচ্ছেন। যা হাসপাতালের সামনেই কয়েকটি ফার্মেসী থেকে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে রোগী অথবা তাদের স্বজনদের। প্রতিটি ওষুধই বাংলাদেশী প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন ওষুধের নামের সাথে মিল রাখা হয়েছে।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ‘জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. শাহরিয়ার তারেক, বহিঃর্বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মাসুদ হাসান এবং হারবাল চিকিৎসক মীর্জা লুৎফুর রহমান তাদের প্রতিটি রোগীর ব্যবস্থাপত্রেই ব্যথার ট্যাবলেট ‘ফ্লাক্সিম্যাক্স, সিরাপ প্রোবিট-জেড, ট্যাবলেট ক্যালেক্সিম, ট্যাবলেট অ্যামিনো এক্সিম’ সেবনের জন্য লিখে দিচ্ছেন। তাদের বেশ কয়েকটি ব্যবস্থাপত্র এসেছে মতবাদের হাতে।

এরা ছাড়াও জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আফিয়া সুলতানা, মেরিনা শারমীন রাখি ও ছোয়া বিশ্বাসের নামও উঠে আসছে কথিত কোম্পানির এসব ওষুধ নামক ফুড সাপ্লিমেন্ট সেবনের পরামর্শ দেয়ার তালিকায়।

এসব কথিত ওষুধের মোড়কে দেখা যায়, ওষুধ নামে এগুলো বিক্রি করা হলেও গায়ে লেখা রয়েছে ফুড সাপ্লিমেন্ট। এছাড়া উৎপাদনের দেশ লেখা রয়েছে ভারতের গুজরাট। প্রতিটি ওষুধের দামই সর্বনিম্ন ২০০ শত টাকা। 

এর মধ্যে প্রোবিট-জেড এর মূল্য ৩৭০ টাকা। যা বাংলাদেশী কোম্পানিতে তৈরি ওষুধের মূল্য ২৫০ টাকা। ট্যাবলেট অ্যামিনো এক্সিমের মূল্য ৭৫০ টাকা হলেও বাংলাদেশে তৈরি এ ওষুধটির দাম ৩০০ টাকা।

ক্যালেক্সিম ট্যাবলেট প্রতি পাতা ৭৫০ টাকায় বিক্রি হলেও বাংলাদেশ এই ওষুধটির মূল্য সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। এছাড়া ফ্লোক্সিম্যাক্স নামের ট্যাবলেটের পাতা এক হাজার ৫০টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশী কোম্পানির উৎপাদিত এ ওষুধটির সর্বোচ্চ মূল্য ২০০ টাকা বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে জেনারেল হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. শাহরিয়ার তারেকের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে অপর মেডিকেল অফিসার ডা. মাসুদ হাসান বলেন, ‘আমি কখনোই ফুড সাপ্লিমেন্ট রোগীদের সাজেস্ট করি না। 

তবে রোগীকে ফুড সাপ্লিমেন্ট সাজেস্ট করার ব্যবস্থাপত্র রয়েছে উল্লেখ করতেই নিজের ব্যবক্ত ঘুরিয়ে ফেলেন এই চিকিৎসক। বলেন, ‘আমি মাঝে মধ্যে একটি সিরাপই দিয়ে থাকি রোগীদের। তাও বেশি না।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ‘রাসেল নামের এক যুবক ভুয়া এ ওষুধ বিক্রির জন্য জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় মার্কেটিংয়ের কাজ করছে। রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ভুয়া ওষুধ লেখার জন্য চিকিৎসকদের কমিশন বা মাসোহারা পৌঁছেও দেন এই যুবক। কমিশন হিসেবে একেকজন চিকিৎসক মাসে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অগ্রিম পেয়ে থাকেন। তবে ‘পট কোম্পানি’র এ ওষুধ সরবরাহকারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল বলেন, ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট একেবারেই লেখা যাবে না এমনটি নয়। রোগীর শরীরে কিছু কিছু ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রয়োজন আছে। 

তবে সেটা অবশ্যই মানসম্পত হতে হবে। জেনারেল হাসপাতালে কোন চিকিৎসক রোগীদের এসব সাজেস্ট করেন কি না, আমার জানা নেই। কেউ অভিযোগ নিয়েও আসেনি।

ফুড সাপ্লিমেন্টের ক্ষতির দিক তুলে ধরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কিছু সাপ্লিমেন্ট শরীরে রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আবার অস্ত্রোপচারের আগে অ্যানাস্থেসিয়ায় প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করতে পারে। 

কিছু সাপ্লিমেন্ট ওষুধের কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে। আবার কিছু ক্যান্সারের ক্যামোথেরাপির কার্যকারিতা হ্রাস করে। গর্ভবর্তী মা অথবা শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে ফুড সাপ্লিমেন্ট।

যদিও ফুড সাপ্লিমেন্ট কি সে সম্পর্কে জানেন না বলে দাবি করেছেন, জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও বরিশাল জেলার সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান। তিনি বলেন, ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ নাম আগে শুনিনি। এটা ওষুধ হয়ে থাকলে সেটা না দেখে কিছু বলা সম্ভব নয়।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট রোগীর ব্যবস্থাপত্রে লেখার কোন সুযোগই নেই। ডাক্তাররা এটা করতে পারবে না। সদর হাসপাতালে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে সেটা সেখানকার আরএমওকে প্রশ্ন করা উচিৎ যে, তাঁর ডাক্তাররা এটা কিভাবে করছে। প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলেন তিনি।
 


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন