যার কাছে যাই দেখি সে-ই মৃত


দুই বছরের কোলের বাচ্চার কান্নার শব্দে জ্ঞান ফেরে। কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু নেই। দেখতে পাই, সবাই আমার মতোই পড়ে আছে। কয়েকটা শিশু কাঁদছে। আমাকে উঠানোর জন্য চিৎকার করে বলছি, কিন্তু আমার কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না। একটু পর কে যেন এসে মাটি থেকে আমাকে তুলল। উঠে দেখি সবাই মৃত। স্বামী, বাবা, নানা-নানি, মামা-মামি, খালা, খালাতো ভাই, চাচাতো বোন, ননদের স্বামী সবাই মারা গেছে।
এভাবেই বজ্রপাতের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন বরের বড় বোন সেলিনা খাতুন। ছোট ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে ৪৭ জন বরযাত্রীসহ কনের বাড়িতে বর-বউ আনতে যাচ্ছিলেন তারা। কনের বাড়িতে পৌঁছার আগেই বৃষ্টিতে আটকে পড়ে বজ্রপাতে ১৭ জনের প্রাণহানি হয়। গন্তব্যের পাঁচ মিনিট দূরত্ব থেকে লাশ হয়ে ফিরে এসেছে বরযাত্রী। বজ্রপাতের ঘটনায় অন্তত ১২ জন বরযাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন।
বুধবার (০৪ আগস্ট) দুপুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাঁকা ঘাটে বজ্রপাতে তাদের মৃত্যু হয়। এ সময় বরপক্ষের ১৬ জনসহ স্থানীয় এক মাঝি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
ঘটনার দিনের বরযাত্রী, নিহতের স্বজন ও প্রতক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার (০২ আগস্ট) শিবগঞ্জের দক্ষিণ পাঁকা গ্রামের হোসেন আলীর মেয়ে সুমি খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয় সদর উপজেলার সূর্যনারায়ণপুর গ্রামের শরিফুল ইসলামের ছেলে আল মামুনের। বুধবার (০৪ আগস্ট) সকালে ৪৭ জন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রওনা হন বরযাত্রীরা। নৌকাটি দক্ষিণ পাঁকা গ্রামের ঘাটে পৌঁছাতেই শুরু হয় বৃষ্টি। এ সময় বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে আশ্রয় নেন ঘাটের ছাউনিতে। সেখানেই হঠাৎ বিকট শব্দে বজ্রপাত হয় এবং ঘটনাস্থলেই তারা মারা যায়।
বজ্রপাতে বেঁচে ফেরা বরের বোন সেলিনা খাতুন বলেন, বজ্রপাত হওয়ার কিছু সময় পর স্থানীয় লোকজন এসে আমাদের উদ্ধার করে। উঠে স্বামীর কাছে গিয়ে তার মুখ-হাত নাড়াচাড়া করছি, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। বাবার কাছে গিয়ে দেখি, তিনিও মারা গেছেন। খালার কাছে গেলাম, খালাও বেঁচে নেই। যার কাছেই যাই, দেখি সেই মৃত। যে কয়েকজন জীবিত ছিল, তাদের মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন এখনো (বৃহস্পতিবার দুপুরে) মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।
সেলিনা খাতুন আরও বলেন, ঘটনাস্থলেই আমার মামা-মামি মারা গেছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তাদের কোলে থাকা তিন বছরের মেয়ে বেঁচে গেছে। বাচ্চাটি এখন মেডিকেলে ভর্তি আছে। খালা ও খালাতো ভাই মারা গেলেও, খালাতো ভাবী বেঁচে গেছেন। তিনি জানান, বৃষ্টির কবলে পড়ে ছাউনিতে আশ্রয় নেওয়ার মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বজ্রপাত হয়। এ সময় একসঙ্গে সবাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। যে ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তার টিনে আগুন ধরেছিল। স্বামীকে হারালেও দুই বছরের ছেলের জন্যই আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন বলে মনে করেন তিনি।
বজ্রপাতে নিহত ১৭ জন হলেন- সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ঘাটাপাড়ার সাত্তার আলীর ছেলে সহবুল (৩০), চর সূর্যনারায়ণপুর গ্রামের টিপুর স্ত্রী বেলী বেগম (৩২), মহরাজনগর ডানপাড়ার জামালের ছেলে লেচন (৫০), রফিকুল ইসলামের ছেলে বাবলু (২৬), একই গ্রামের মৃত সৈয়ব আলীর ছেলে তবজুল (৭০), তবজুলের স্ত্রী জমিলা (৫৮), ছেলে সাদল (৩৫), তেররশিয়া দক্ষিণপাড়ার মৃত মহবুলের ছেলে রফিকুল (৬০), সূর্যনারায়ণপুরের ধুনু মিয়ার ছেলে সজিব (২২), একই গ্রামের সাহালালের স্ত্রী মৌসুমী (২৫), বাবুডাইংয়ের মকবুলের ছেলে টিপু (৪৫), কালুর ছেলে আলম (৪০), মোস্তফার ছেলে পাতু (৪০), সুন্দরপুরের সেরাজুলের ছেলে আতিকুল ইসলাম ডাকু (২৪), ফাটাপাড়ার সাদিকুলের স্ত্রী টকি বেগম (৩০) ও জনতার হাট গ্রামের শাহালাল ওরফে বাবুর ছেলে তামিম (৫) ও নৌকার মাঝি শিবগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ পাঁকা গ্রামের রফিকুল ইসলাম।
বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যুর ঘটনায় নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ। এ দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মীয়-স্বজন ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিয়েবাড়িতে এখন শোক আর আহাজারি। নিহতের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিত্তবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
এইচকেআর
