গর্ভধারীনি মাকে ভালোবাসার দৃষ্টান্ত জিয়াউল-রাকিব


বরিশাল : নিজের শরীরে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বেধে করোনা আক্রান্ত মাকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা যুবকের পরিচয় মিলেছে। তিনি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি পৌরসভার জিয়াউল হাসান। তিনি ঝালকাঠি জেলা সদরের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক শাখার সিনিয়র অফিসার পদে কর্মরত রয়েছেন। তার ছোট ভাই রাকিব হাসান চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে লেখাপড়া করেন।
আর সবার বড় ভাই মেহেদী হাসান খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের দেওলতপুর থানায় সাব-ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত রয়েছেন। জিয়াউল হাসানের পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুল হাকিম মোল্লা। তিনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার। ২০২০ সালের প্রথম রমজানে হাকিম মোল্লা মৃত্যুবরণ করেন। নলছিটি পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড সূর্যপাশা গ্রামের বাসিন্দা তারা। মা রেহানা পারভীন নলছিটি বন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।
বড় ভাই খুলনায় থাকায় মেঝ জিয়াউল হাসান ও ছোট ভাই রাকিব হাসান মিলে মাকে নিয়ে শরীরে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেধে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হন। এরমধ্যে জিয়াউল হাসান গায়ে বেধে নেন সিলিন্ডার, তার পাশেই আরেকটি মোটরসাইকেলে মাকে পাহারা দিতে দিতে আসছিলেন রাকিব।
জিয়াউল হাসান বলেন, তার মা রেহানা পারভীন (৪৮) দীর্ঘ দশ দিন ধরেই অসুস্থ। করোনার সবগুলো উপসর্গ ছিল শরীরে। রেহানা পারভীন করোনা সংক্রমতি কিনা সেটি নিশ্চিতের জন্য স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরটি পিসিআর ল্যাবে মায়ের করোনা পরীক্ষা করার। কিন্তু দশ দিনেও পরীক্ষার ফলাফল না পেলেও মায়ের শারীরীক অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় বাসায় সংস্থান করেন অক্সিজেন সিলিন্ডার।
সেখানে অক্সিজেন ফুরিয়ে যেতে বসলে জিয়াউল ও রাকিবুল সিদ্ধান্ত নেন মাকে যে করেই হোকে চিকিৎসা করাতে হবে। কিন্তু গাড়ি না পাওয়ায় শেষে নিজের শরীরে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেধে নেন জিয়াউল; তখনো মায়ের মুখে অক্সিজেন মাস্ক। পাশে আরেকটি মোটরসাইকেলে ছোট ভাই রাকিব। সন্ধ্যার আগে এসে পৌঁছেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে। বর্তমানে সেই নারী করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন। সাথে আছেন দুই ভাই।
জিয়াউল হাসান বলেন, এর পিছনে একটু কষ্টের কথা আছে। বিগত দশ দিন হলো মায়ের ১০৪/৫ ডিগ্রি জ্বর, কাশি, সর্দি শরীর ব্যথা ও পাতলা পায়খানা ছিল। গত শনিবার (১০ এপ্রিল) নলছিটি হাসপাতালে কভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল দিয়ে আসি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবী, তারা সেই স্যাম্পলটি বরিশাল পাঠিয়েছেন; বরিশাল থেকে সম্ভবত ঢাকা পাঠানো হয়েছে। সেটি ওনাদের ধারণা। কিন্তু সেই স্যাম্পলের রেজাল্ট আমরা আজ পর্যন্ত পাইনি।
উপুজলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভরসা করতে না পেরে গত বৃহস্পতিবার বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চলে আসেন। এখানে স্যাম্পল দেন এবং তার এক আত্মীয় রয়েছেন জেলা প্রশাসক, সেই ভাইয়ের সুপারিশে করোনা পরীক্ষাটি দ্রুত করাতে পারেন। সেদিনের দেওয়া স্যাম্পালের রেজাল্ট শনিবার রাত ১২টার দিকে মোবাইলে আসে বলে জানান জিয়াউল হাসান।
পিসিআর টেস্টের রেজাল্ট পায়নি উল্লেখ করে বলেন, তবে রেন্টিজেন্ট পরীক্ষায় পজেটিভ আসায় বৃহস্পতিবার বাসায় একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে গিয়েছিলাম।
জিয়াউল হাসান বলেন, গত দুইদিন রাখার পরে দেখলাম মা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আজকে (শনিবার) দেখলাম মায়ের অক্সিজেন লেভলটি ৯৪-৯৩ নেমে যাচ্ছে। দুপুরে দেখলাম মায়ের অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে। সেজন্য ভাবলাম ঝুঁকিটা নেওয়া ঠিক হবে না।
মাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য আমি অ্যাম্বুলেন্স চেষ্টা করেছি, পারিনি। একটা মাহিন্দ্রা ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করেছি; পারিনি। একটা অটো রিকশা রিজার্ভ করার চেষ্টা করেছি; পারিনি। শেষে মোটরসাইকেল আনার সিদ্ধান্ত নেই। এটি শুনে মা ভয় পাচ্ছিলেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সচিবের সুপারিশে একটি আলাদা কক্ষ ম্যানেজ করতে পেরেছেন উল্লেখ করে জিয়াউল হাসান বলেন, তারপরও আমি যথেষ্ঠ ভোগান্তির শিকার হয়েছি। আমি শনিবার সকালে নলছিটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মেহেদী হাসানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি করতে পারি? তিনি আমাকে বলেছেন, যেটা ভালো হয় আমি যেন সেটা করি। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মেহেদী হাসান আমাকে পরামশ দেন যেনম, বরিশাল হাসপাতালে আসি। মূলত, তারা এই ব্যাপারে কোন রিস্ক নিতে চান না।
জিয়াউল হাসান যুক্ত করেন, বরিশাল বিশ্ববদ্যিালয়ের সামনে আসলে আমি প্রস্তুত হয়েই থেমে গেছি। সেখানে অনেক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছিল। আমি নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেই, যেহেতু আমার কাছে একটি সিলিন্ডার আছে। এটি দেখে অন্তত আমাকে কোন ঝামেলায় ফেলবে না। আমি সেখানে দাড়ানোর পর পুলিশ সদস্যরা ছুটে এসেছেন। আমি বলেছি, আমার মা রোগী। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করতে হবে। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা খুব একটা বিড়ম্বনা করেননি। তবে আমার সাথে ছোট ভাই ছিল আরেকটি মোটরসাইকেলে। তাদের থামিয়ে হেলমেটের বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, ওরা রোগীর সাথে এসেছে। শেষে ছেড়ে দিয়েছে। নলছিটি থেকে বরিশাল আসতে গিয়ে দুই স্থানে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন তারা।
ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, আই হ্যাভ নো ওয়ে টু গো। আমাকে যেতেই হবে। এছাড়াতো উপায় নেই আমার। আমিতো দৌড়ে আসতে পারবো না। আমি চেষ্টা করেছি সব পথ; কিন্তু পারিনি। শেষে আমার গায়ের সাথে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেধে নিয়ে এসেছি, আমি বুঝতেছিলাম মায়ের কষ্ট হচ্ছিল। আমি মাকে একটি কথাই বলতেছিলাম, এছাড়া উপায় নেই মা। এটা ছাড়া আমার কোন বিকল্পও ছিল না। এছাড়া কোন উপায়ও ছিল না, আমার মায়ের কষ্ট হচ্ছিল; তা আমি সহ্য করতে পারিনি। এ থেকে বড় কোন কথাও নেই।
এসএমএইচ
