ডলারের অস্বাভাবিক দরের কারণে হুহু করে বাড়ছে চিনির দাম
দাম নাগালে রাখতে সরকার চিনির আমদানি শুল্ক অর্ধেক করলেও তা কাজে আসেনি। বরং ডলারের অস্বাভাবিক দরের কারণে হুহু করে বাড়ছে পণ্যটির দাম। দুই সপ্তাহ ব্যবধানে কেজিতে ১৫-২০ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ টাকা। সরবরাহে টান পড়ায় বাড়তি টাকা দিয়েও দোকানে মিলছে না খোলা চিনি। চার দিন ধরে উধাও প্যাকেটজাত চিনি। চিনির সরবরাহ এবং দাম নিয়ে ভিন্ন যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন খুচরা, পাইকারি ও আমদানিকারকরা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৮-১০ দিনের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এরই প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।
তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, মিলগেট থেকেই তাদের ১৩৭ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ যুক্ত হওয়ায় বাড়তি দামে বেচতে হচ্ছে। আর আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য, ডলারের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে। শতভাগ মার্জিন দিয়েও ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না। আবার আন্তর্জাতিক বাজারেও চড়া চিনির দর। গ্যাসের চাপ কম থাকায় কারখানায় ব্যাহত হয়েছে উৎপাদন। দুটি কোম্পানির কারখানায় চিনি উৎপাদন প্রায় বন্ধ। সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের দাম সমন্বয় করার আহ্বান জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।
তবে বাস্তবতা হলো– নিত্যপণ্য হিসেবে সরকার ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো যতবার চিনির দর নির্ধারণ করেছে, তা একবারও কার্যকর হয়নি।
মিল থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ে যে যার মতো দাম বাড়িয়েছে। প্রায় তিন মাস আগে খোলা চিনির কেজি ১৩০ ও প্যাকেটজাত ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাজারে কোথাও এ দামে চিনি মেলেনি। ১০-১২ দিন আগেও খোলা চিনি ১৩০ ও প্যাকেটজাত ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে গতকাল রোববার রাজধানীর মালিবাগ, মহাখালী ও কারওয়ান বাজারে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে খোলা চিনির কেজি ১৫০ টাকা। অবশ্য আগে কেনা এমন দু-এক জায়গায় ১৪৫ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। আবার চিনি সব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচ-ছয় দোকান খুঁজে একটিতে মিলছে। দাম বাড়ার কারণে অনেকেই পরিচিত ও বিশ্বস্ত ছাড়া কারও কাছে বিক্রি করছেন না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। যদিও আমদানিকারকদের ভাষ্য, বহুমুখী ব্যবহারের কারণে চাহিদা বেড়ে ২৫ থেকে ২৭ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে, যার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। দেশে ১৫টির মধ্যে এখন ৯টি চিনিকল চালু থাকলেও উৎপাদন তলানিতে। সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ২১ হাজার টন।
দাম নাগালে রাখতে গত ১ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানির শুল্ক ৩ হাজার থেকে কমিয়ে দেড় হাজার এবং পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে ৬ হাজার থেকে কমিয়ে ৩ হাজার টাকা করে। শুল্ক কমানোর দিনই বাজারে কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছিল। সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্যে, চিনির খুচরা দাম এক মাস আগের তুলনায় ৭ দশমিক ৫৫ এবং এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাশেম বলেন, এখন মিলগেটে ১৩৭ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে সরবরাহ কম ছিল। আশা করছি, শিগগির সরবরাহ বাড়বে।
ডলারের দাম বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যাহতের কারণে বাজারে সরবরাহ কমছে বলে জানান আমদানিকারকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আমদানিকারক বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম এখন অনেক বেশি, প্রতি টন প্রায় ৭০০ ডলার। শুল্কসহ অন্যান্য খরচ প্রতি টনে প্রায় ৪২ হাজার টাকা। আগে ৫০ শতাংশ মার্জিন দিয়ে ঋণপত্র বা এলসি খোলা যেত, যা এখন শতভাগ মার্জিন দিয়েও সম্ভব হচ্ছে না। সিটি ও ঈগলুর চিনি উৎপাদন প্রায় বন্ধ।
এস আলম গ্রুপের সিনিয়র ব্যবস্থাপক সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘দুটি কারণে বাজারে চিনির সরবরাহ কম। ডলারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারেও দর চড়া। চিনির আমদানি শুল্ক অর্ধেক করাই কেজিতে দেড় টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। বিপরীতে গত কয়েক দিনে ডলারের দাম ৬ থেকে ৭ টাকা বেড়েছে।’
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহকারী ব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘ডলার দাম সমন্বয় ছাড়া চিনির দাম যৌক্তিক পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া কারখানায় গ্যাসের চাপ কমে উৎপাদন ব্যাহতের কারণেও সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।’
এমএন