দেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যতা এখন বরিশালে, জনপ্রতিনিধিদের জবাব কী

-----বিপ্লব রায়, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মতবাদ
একদিকে বরিশাল বিভাগের জনপ্রতিনিধিরা সম্পদ-সম্পত্তিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন, অন্যদিকে এক সময়ে উত্তরাঞ্চলের দারিদ্রতা এখন বরিশালে গাঁট বেঁধেছে। অথচ উন্নয়নের ধুয়া দিয়ে আবারো ভোট চাইছেন এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিরা। কারণ, দারিদ্রতা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের কোনো রকম ভোট নামের একটা বৈতরণী পার হতে পারলেই জীবন ফকফকা। ইউরোপ-আমেরিকায় তাদের বাড়ি, গাড়ি বিত্ত-বৈভব সব হয়ে যায়। আবারও তারা ৫ বছর পর পর ভোটের নামে জনগণের কাছে মিথ্যা প্রতিশ্রæতি দেয়। ভোট চায়।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে- বরিশাল বিভাগ দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ দারিদ্র্যতার কবলে পড়েছে, এ নিয়ে জাতীয় দৈনিক গুলোতে বিভিন্ন রকম মুখরোচক সংবাদ শিরোনাম করেছে। প্রথম আলোর শিরোনাম ‘রংপুরের দারিদ্র্য এখন বরিশালে ‘অভিবাসনে’ গেছে (২৭ ডিসেম্বর ২০২৩)। আরটিভি অনলাইনে ছেপেছে- রংপুর নয়, দারিদ্র্য এখন বরিশালে (৩০ ডিসেম্বর ২০২৩)। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড লিখেছে- রংপুর নয়, সবচেয়ে বেশি দরিদ্র এখন বরিশালে (২৮ ডিসেম্বর ২০২৩), হুবহু প্রায় একই রকম শিরোনাম করেছে ডিবিসি অনলাইনেও (৩০ ডিসেম্বর ২০২৩)। এছাড়া ঢাকা ট্রিবিউন লিখেছে বরিশালে গরিব বেশি, শৌচাগারও কম (২৮ ডিসেম্বর ২০২৩)।
বরিশালের মানুষকে ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকার লোকজন নানা কারণে একটু ঈর্ষার চোখে দেখে। এবার আমরা তাদের হাসির পাত্র হলাম। বাহ! দারুণ না ব্যাপারটা?
অবশ্য এ নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কারণ নেই। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো, নির্বাচনী হলফনামায় আমাদের এক জনপ্রতিনিধির সম্পদ বেড়েছে ৬৭ গুণ। আমার নেই, আমাদের নেতার তো আছে। (এটা তো ঘোষিত সম্পদের হিসাব। অঘোষিত চিপায় পড়া আরো কত যে আছে, তার হিসাব নাই। এ তো গেল একজনের, বাকিদেরও টাকা রাখার জায়গা নেই।) কিন্তু বলতে মানা। কারণ ক্ষমতার জোরে তারা শক্তিমান। তাদের সঙ্গে নিরাপত্তা প্রহরী থাকে সার্বক্ষণ। দেখা করতে গেলে প্যাদার কাছে অনুরোধ করে নাম লেখাতে হয়। প্যাদা ইচ্ছে হলে নেতার সান্নিধ্য দিতেও পারেন, না হলে পত্রিকার পাতায় ছবি দেখতে হয়। নেতার কাছে যাওয়ার ভাগ্য, কিছু পাওয়ার ভাগ্য আর হয় না।
গত ২৭ ডিসেম্বর বুধবার খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার এখন বরিশাল বিভাগে। এ দারিদ্র্যের হার ২৬.৯ শতাংশ। ২০১৬ সালে বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্য হার ছিল ২৬.৫ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম খুলনা বিভাগে। এই বিভাগের দারিদ্র্যের হার ১৪.৮ শতাংশ।
বিবিএস বলছে, গত ছয় বছরে ঢাকা, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। এখন ঢাকায় দারিদ্র্যের হার ১৭.৯%, চট্টগ্রামে ১৫.৮%, রাজশাহীতে ১৬.৭%, সিলেটে ১৭.৪%, রংপুরে ২৪.৮% আর ময়মনসিংহে ২৪.২%।
রংপুর বিভাগে দারিদ্র্য ২৪.৮%। ২০১৬ সালে এই বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৭.২%। ছয় বছরের ব্যবধানে এত দ্রæত দারিদ্র্য কমানোর রেকর্ড অন্য কোনো বিভাগের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
দেশে এখন সার্বিক দারিদ্র্যের হার ১৮.৭%। ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩%। দেশে অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬%; ছয় বছর আগে এই হার ছিল ১২.৯%।
রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যতা কমেছে- এমন আভাস মিলেছিল বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সীর মুখেই। তিনি বলেছিলেন, রংপুর এলাকায় এখন আর গরিব মানুষ নেই। মহিলারা তিনবার লিপস্টিক লাগাচ্ছেন, চার বার স্যান্ডেল বদলাচ্ছেন (৮ নভেম্বর-২৩ প্রথম আলো অনলাইন)।
এতোদিন পর বোঝা গেল, বাণিজ্যমন্ত্রী সত্যি কথা বলেছেন। তাহলে এবার এই অঞ্চলের মায়া কান্না করা জনপ্রতিনিধিরা কী বলবেন? সবই তো আপনাদের অবদান।
বরিশাল অঞ্চলে একটি পাতাকপি কিংবা ফুল কপিও বিক্রি হয় কেজি দরে। প্রতি কেজি ৬০-৭০ টাকা দাম। দেশের আর কোথাও এমন অবস্থা আছে কি না, আমার জানা নেই। লাল রঙা মুলা বিক্রি হচ্ছে হালিমূলে। অর্থাৎ চারটায় এক মুঠি। দাম ৩০-১০ টাকা। ভাবা যায়? যে যেভাবে পারছে, মানুষকে ঠকাচ্ছে। মুলা তো কেজি দরে বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে হালিতে। আগে কমলা বিক্রি হতো হালি বা ডজনমূলে। কয়েক বছর ধরে বিক্রি হচ্ছে কেজিতে। ডিম একটু স্বাস্থ্যবান হলে তিনিও ডিজিটাল বাটখারায় উঠতে পারতেন। হয়তো হবে ভবিষ্যতে।
উৎপাদনের বর্তমান মৌসুমে এখনও আলুর দাম ৭০-৮০ টাকায় ওঠানামা করছে। অন্যান্য শাক সবজির দাম আকাশ ছোঁয়া। গরিব-মধ্যবিত্তের ব্রয়লার মুরগিও এখন আর তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। এই মাংসের কেজিও ডাবল সেঞ্চুরি করেছে। গরু-খাসি, দেশি মুরগি এখন বিলাসী খাবার। এছাড়া ৫০০ টাকার একটা নোট না হলে এক কেজি সাধারণ মাছও জোটে না এখন। তাহলে মানুষ বাঁচে কী করে? কেউ খবর নিয়েছেন?
খবর নিয়ে লাভ নাই। জনপ্রতিনিধিরা জানে, পয়সা দিয়ে ভোট কিনি আবার এতো কথার দরকার কী? কিন্তু ভাই, সাধারণ কিছু মানুষের চরিত্র আপনারা নষ্ট করেছেন। সবাই তো পয়সায় ভোট দেয় না।
আমাদের জনপ্রতিনিধিরা এই দারিদ্রের তকমা নিয়ে কেউ কিছু বলে না। শুধু উন্নয়নের ধুয়া দিয়ে ভোট চায়। ভোটে কোনরকম জিতেই ঢাকায় কিংবা বিদেশে বিলাসী জীবন।
এসব নিয়ম ভাঙা দরকার। দরকার জনগণের সচেতনতা। দরকার নৈতিক ও মানবিক জনপ্রতিনিধি। কিন্তু কোথায় পাবো তারে !
এমএন