আমন উৎপাদনে রেকর্ড, তবুও বাড়ছে চালের দাম

বরিশালে আমন মৌসুমের ধান কাটা-মাড়াই প্রায় শেষের দিকে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চলতি আমনের উৎপাদন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বাজারে আমনের চাল সরবরাহও হচ্ছে ডিসেম্বরের শুরু থেকে।
এ সরবরাহ পুরোদমে থাকলেও এখন মিল, পাইকারি ও খুচরা প্রায় সব পর্যায়ে চালের দাম বাড়ছে। শুধু পাইকারিতেই গত এক সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫-৭ টাকা।
অভিযোগ উঠছে, মুনাফা বাড়ানোর প্রবণতা থেকে মিল পর্যায়েই কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে কেনা চালের মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। চলতি আমন মৌসুমে বরিশাল বিভাগে ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ৬২৪ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর। মোট ১ হাজার ৯০৩ হেক্টর জমিতে এ বছর ধানের আবাদ করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ১৭ লাখ ৩৩ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ৯২ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে ১০০ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন করা হবে বলে জানিয়েছেন বরিশাল বিভাগীয় কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শওকত ওসমান।
তিনি বলেন, গত বছরের শেষ দিকে পোকামাকড় এবং ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ও মিগজাউমের প্রভাবে বোরো চাষাবাদে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে এবার পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় এবার রেকর্ড পরিমাণ আমনে ধান উৎপাদন হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে রেকর্ড উৎপাদনের দাবি করা হলেও বাজারে এখন আকস্মিকভাবেই দাম বেড়েছে চালের। নগরীর ফরিয়াপট্টির খোকন চন্দ্র ঘোষের চাল আড়তের ম্যানেজার বাবুল হোসেন জানান, গত কয়েকদিনে বিভিন্ন চালে প্রতি কেজিতে প্রায় ৩-৪ টাকা বেড়েছে।
তিন-চারদিন আগেও এখানে প্রতি বস্তা (২৫ কেজি) ব্রি-২৮ চাল ১ হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকা দরে। মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬৫০ টাকায়। কয়েকদিন আগে যার দাম ছিল ১ হাজার ৫৫০ টাকা।
আর মোটা বুলেট ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা কয়েকদিন আগেও ছিল ১১২০ টাকা। তিনি বলেন, আমনের ভরা মৌসুমেই মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে চালের দাম বেড়ে গেছে।
চালের দাম বাড়ানোর দুটি কারণ উল্লেখ করে ফরিয়াপট্টির চালের বড় মোকাম খাদ্য ভাণ্ডারের মালিক স্বপন দত্ত বলেন, সরকার গুদাম থেকে সর্বনিন্ম স্বর্ণা গুটি চাল ৪৪ টাকা কেজি দরে কিনছে। কিন্তু বাজারে এই চাল ৪২ টাকা কেজিত বিক্রি করছি।
সরকারের চাল কেনাকে পূঁজি করে ধান বিক্রেতারা তাদের ধানের মূল্য বাড়িয়ে দিছে। এ কারণে মিল মালিকরাও চাল কেজিতে ২-৩ টাকা বাড়িয়ে দেয়।
এর প্রভাব চালের বাজারে পড়ায় ব্যবসায়িরা একটু দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে। তিনি বলেন, সরকার দেশ থেকে থেকে এই নিন্মমানের চাল না কিনে বিদেশ থেকে আমদানি করলে চালের বাজার স্থতিশীল থাকতো বলে জানিয়েছেন চাল ব্যবসায়ী স্বপন দত্ত।
এদিকে চালের দাম বাড়ায় ধান ব্যবসায়ীকে দায়ী করেছেন নগরীর বাজার রোডের বৃহতম পাইকারী চালের মোকাম প্রতিভা ট্রেডার্সের স্বত্তাধিকারী মুছা জামিল সান।
তিনি জানান, প্রতি বছর মৌসুমে আমন ধানের মোটা চাল বের হয়। এই চাল মধ্যবিত্ত থেকে নিন্ম শ্রেণীর মানুষদের চাহিদা বেশি থাকে। সরকার চাল ও ধান কেনার ঘোষণা দিলেই ধান বিক্রেতাদের চাহিদা বাড়ে। অনেক চাল ব্যবসায়ী তাদের কাছ থেকে সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ধান কিনে থাকে।
ফলে চালকল মালিকররাও ধান ব্যবসায়ীদের মতো কেজিতে ২-৩ টাকা বাড়িয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে চালের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, সপ্তাহ দুই আগে দাদা মিনিকেট ২৫ কেজি চাল কুষ্টিয়া অটো রাইস মিল থেকে ১৬৫০ টাকা বস্তা কিনেছি। আমরা পাইকারে এই চাল ১৭০০ টাকা বিক্রি করেছিলাম। তবে গত ৫দিন ধরে এই চালের বস্তা ১৬২০ থেকে ১৬৩০ টাকায় বিক্রি করছি। কারণ আগে কিনে রাখা ছিল।
এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী করছেন পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের। নগরীর সাগরদী এলাকার খুচরা চাল বিক্রেতা নয়ন জমাদ্দার বলেন, আমরা এক সপ্তাহ যাবত বেশি দামে চাল কিনছি। তাই প্রতি কেজিতে ২-৩ টাকা বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। খুচরা বাজারে কোনো সিন্ডিকেট হয় না। মিল ও পাইকারি পর্যায়ে অভিযান শুরু হলেই চালের বাজারে স্বস্তি ফিরবে।
যদিও চালকল মালিকরা দাবি করছেন, চালের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বাভাবিক। ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার মাহমুদ নিয়াজ বলেন, সহজেই চাল ব্যবসায়ীরা মিল মালিকদের দায়ী করেন।
কিন্তু তারা জানেন না ধানের সংকটের কারণে অধিকাংশ মিল বন্ধ রয়েছে। এমনকি আমার (জুলফিকারের) মিলও বন্ধ। ধান না পেলে তাদের কাছে চাল কিভাবে বিক্রি করবো। চালকল ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে চাল বিক্রি করচ্ছে না বলে বিষয়টি সংবাদকর্মীদের খুঁজে দেখার জন্য অনুরোধ করেছেন চালকল নেতা জুলফিকার মাহমুদ নিয়াজ।
বরিশাল ফড়িয়াপট্টির চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আলম বলেন, গত ডিসেম্বর মাস থেকেই চালের দাম একটু বাড়তি। গত কয়েকদিনে ২৫ কেজি চালের দাম প্রতি বস্তা ৪০-৫০ টাকা বেড়েছে। আগামী দ্-ুএকদিনের চালের দাম আগের দামে ফিরে আসতে পারে বলে জানান ফারুক আলম।
এদিকে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে শঙ্কায় পড়ে গেছেন নগরীর স্বল্প আয়ের মানুষেরা। খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা রিকশাচালক ছোলায়মান সরদার বলেন, নির্বাচনের কারণে এমনিতেই রাস্তাঘাটে মানুষ কম বের হয়েছে।
তাই গত মাসের তুলনায় দৈনিক আয় কমেছে অন্তত ১০০ টাকা। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের পাশাপাশি চালের দাম বাড়াই (বেড়েছে) গেছে। জিনিসপত্রের দাম এইভাবে বাড়লে গরিব মানুষরা না খেয়ে মরবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মারুফুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে জমি কম তবুও উৎপাদন হচ্ছে। আমন মৌসুম চলছে, প্রায় মাড়াই প্রায় শেষের দিকে। উৎপাদন ভালো হচ্ছে, তারপরেও বাজারে হঠাৎ চালের দাম বাড়ছে কেন?
সরকারি মজুদ আরো শক্তিশালী করলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে পারেন না। চালের ক্ষেত্রে দাম বাড়লে তার প্রভাব দেশের মানুষের ওপর বেশি পড়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রশাসনের দপ্তরকে চালের বাজারে মনিটরিং করা দরকার।
এদিকে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন বরিশাল বিভাগীয় কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শওকত ওসমান বলেন, এ বছর আমনের রেকর্ড পরিমাণ ফলন হওয়ায় বাজারে কোনো সংকট নেই। তাই চালের দাম হুট করে বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। প্রশাসনের সহযোগিতায় শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এমএন