ঢাকা শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫

Motobad news
শিরোনাম

পিরোজপুরে প্রার্থী মনোনয়ন ভুলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি

পিরোজপুরে প্রার্থী মনোনয়ন ভুলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

প্রথম ধাপের অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে পিরোজপুর জেলার ৩২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মাত্র ১৯টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। বাকী ১৩টি ইউনিয়নের ১০টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং ৩টি ইউনিয়নে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি’র জাতীয় পার্টি (জেপি) প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ৯ জনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।

নৌকার প্রার্থীদের ভরাডুবির জন্য মনোনয়ন ভুলকেই দায়ী করছে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

জেলার ৩২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩০টি ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিপরীতে এক বা একাধিক আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বিদ্রোহী হয়েও ৯টি ইউনিয়নে দলীয় নৌকা প্রতীককের প্রার্থীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত লোককে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের অনেকেই মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। কোন কোন ইউনিয়নে এমন সব ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কেউ দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হয়েছেন। কারো বিরুদ্ধে সরকারী মালামাল আত্মসাতের মামলা রয়েছে। এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করারও অভিযোগ আছে কোন কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে। আবার মনোনয়ন পাওয়া অনেক প্রার্থীর সাথে দলীয় নেতাকর্মী যোগাযোগ ছিল না। ফলে মাঠের নেতাকর্মীরা দল মনোনীত এসব প্রার্থীকে সহজে গ্রহণ করতে পারেনি।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় ৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুটিতে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। উপজেলা সদর ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান মোশারেফ হোসেন খান এবং সেখমাটিয়া ইউনিয়নে উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও কৃষকলীগ নেতা আতিয়ার রহমান চৌধুরী নান্নু নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন।

উপজেলার মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন বুলুকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদুল ইসলাম বিলু আনারস প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। নৌকার প্রার্থী বেলায়েত হোসেন বুলুর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় এলাকার জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে সরকারী মালামাল আত্মসাতের মামলা বিচারাধীন রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান ফকির বলেন, এ ইউনিয়নের নৌকার পরাজিত প্রার্থী বেলায়েত হোসেন বুলু ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের দূরে রেখে জামাত-বিএনপি নিয়ে চলতেন। সাধারণ মানুষের কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘরসহ টিউবওয়েল দেয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাত করেছেন। এমনকি সরকারী ব্রীজের মালামাল আত্মসাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। এসব কারণে জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এলাকায় নৌকার জনসর্মথন থাকলেও নৌকার প্রার্থী মনোনয়নে ভুল হওয়ায় এ ইউনিয়নে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে।

মালিখালী ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান ও নৌকার প্রার্থী সুমন মন্ডল মিঠুকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী রুহুল আমিন বাবলু দাড়িয়া আনারস প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। নৌকার প্রার্থী সুমন মন্ডল মিঠুর বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। এমনকি দুর্নীতির অভিযোগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তাকে চেয়ারম্যান পদ সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

মালিখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার হালদার জানান, নৌকার পরাজিত প্রার্থী সুমন মন্ডল মিঠু পর পর দুই বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ১০ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন। দ্বিতীয় বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে গত ৫ বছরে নানা কর্মকান্ডে তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। দলীয় নেতাকর্মীদের সাথেও তিনি যোগাযোগ রাখেন নি। এমনকি পরিষদের সদস্যদের সাথেও তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। নিজের একক সিদ্ধান্তে পরিষদ পরিচালনা করেছেন। এসব কারণে দলীয় নেতাকর্মীসহ ভোটাররা তাকে বয়কট করেছে।

মালিখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মহসিন শিকদার বলেন, নৌকার প্রার্থী মনোনয়ন সঠিক না হওয়ায় মালিখালীতে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। এ ভরাডুবির জন্য প্রার্থীর ব্যার্থতাই দায়ী।
মালিখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, আওয়ামী লীগের প্রার্থী মিঠু মন্ডল এলাকার মানুষের কাছ থেকে এতোটাই প্রত্যাখিত হয়েছেন যে, নির্বাচনের দিনে ইউনিয়নের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র এলাকায় তিনি কোন নির্বাচনী ক্যাম্প পর্যন্ত করতে পারেন নি।

পিরোজপুর সদর উপজেলার কদমতলা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মো. হানিফ খানের বিরুদ্ধে এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তিনি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে বসে সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে তারই ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করেছেন। তার বিরুদ্ধে পিরোজপুর থানায় বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগে মামলাও রয়েছে। বর্তমানে তিনি আদালত থেকে জামিনে আছেন।

নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী) উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. এস এম ফুয়াদ বলেন, নির্বাচন শতভাগ অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টিতে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। বাকি ৪টিতে বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছে। তারাও আওয়ামী লীগের লোক। অন্যকোন দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করায় ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরূপকাঠী উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, যে ৪টি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী পরাজিত হয়েছে তারা সকলেই আওয়ামী লীগের দলীয় বর্তমান চেয়ারম্যান ছিল। তবে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করা, দলীয় লোকজনসহ এলাকার জনগণের সাথে ভাল সম্পর্ক না থাকার কারণে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাই তারা দলীয় মনোনয়ন পেলেও জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি আরও জানান, নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যে করে এসব জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের নাম কেন্দ্রে পাঠনো হয়েছে।

পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আকতারুজ্জামান ফুলু জানান, যেসব ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন তারা নানা কারণে জণগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে জনবিচ্ছিন্ন ছিল। দলের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ ছিল না। এসব কারণে তারা পরাজিত হয়েছেন। অনেকেই বর্তমান চেয়ারম্যান থাকায় তাদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ থাকায় জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এছাড়া দলীয় মনোনয়নে কেন্দ্র তালিকা পাঠানোর বিষয়েও পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক প্রার্থী মনোনয়ন পায় নি।


এমবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ