ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫

Motobad news
শিরোনাম

সংস্কৃতির অন্তরালে সাম্প্রদায়িকতা

সংস্কৃতির অন্তরালে সাম্প্রদায়িকতা
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

কাজল কুমার দাস


অপসাংস্কৃতি আর ধর্মান্ধতার আগ্রাসনে এমনিতেই আমরা হারাতে বসেছি আমাদের ঐতিহ্যকে। তাইতো স্বাধীনতার ৫১তম বর্ষে এসেও আমরা শুনতে হচ্ছে-পহেলা বৈশাখ হিন্দুয়ালী সংস্কৃতি, বাঙ্গালীদের নয়। আপনি হয়ত বলবেন- ভাই এসবতো সেই পুরনো কথা। কথাটা পুরনো নাকি নুতন সেটা আলোচ্য নয় বরংচ এসব রটনার নেপথ্যে যেসব কারিগর বসে আছেন সাংস্কৃতিজনের বেশে তাদের মুখোশটা উন্মোচন খুবই জরুরী। 

২০০১ সালে রমনার বটমুলে বোমা হামলা যতটা ক্ষতি করেছে তার থেকেও বেশী ক্ষতি হচ্ছে “পহেলা বৈশাখ হিন্দুয়ানী উৎসব এবং তা পালন করা হারাম” এই জাতীয় আগ্রাসন। প্রতিক্রিয়াশীল এসব মৌলবাদীদের হয়ত আপনি রুখেই দিলেন কিন্তু “হিন্দুরা বাংলাদেশের নিয়মে পহেলা বৈশাখ পালন করে না, এরা দেশদ্রোহী....” এসব কথা বলা প্রগতিশীলতার অন্তরালের মৌলবাদীদের রুখবেন কি দিয়ে? ভাবছেন, হঠাৎ করে এসব আলাপ কেন? আর এরাই বা কারা?... এসব প্রশ্ন আপনার মাথায় আসাটা অলীক কোন ভাবনা নয়। আসুন আলাপ করি!

আপনি এসব প্রগতিশীল মৌলবাদীদের কি কখনো প্রশ্ন করেছেন! এদেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ এখনো এদেশের প্রবর্তিত দিনে-নিয়মে ঈদ পালন করে না কেন? একদিন আগে বা পরে ঈদ পালন করাও কি তবে এদের রাষ্ট্রদ্রোহীতা? আসলে এসব প্রশ্ন বা আলোচনা করে জাস্টিফাই করা নয়, ভণ্ড আর বদমায়েশদের সাথে কোন প্রতিযোগিতাও নয়। জানি এর উত্তর ওদের কাছে নেই। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি ধর্ম বা সাংস্কৃতি প্রতিটি মানুষেরই স্বাধীনতা; কে-কেমন করে তার ধর্ম বা সংস্কৃতিকে পালন করবে সেটা তার ব্যাপার। এই স্বাধীনতা বুঝতে হলে মনটাকে মুক্ত করতে হয়, যা সবার জন্য সহজ নয়।

এবার শুরুতেই আপনাদের একটা তথ্য দিই। এবছর বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ ছিলো চৌদ্দ এপ্রিল, কিন্তু ওইদিন বাংলাদেশের হিন্দুরা পহেলা বৈশাখ পালন করেনি। কিন্তু কেন? দাঁড়ান। এর কারণ এটা না যে হিন্দুরা পশ্চিমবাংলাকে তাদের ঠাকুরঘর মনে করে। এর কারণ এটা যে, যখন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এদেশে, তখন সেই সিদ্ধান্তে সাতচল্লিশে ভিটে না ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর কথা থাকেনা, আজব্দি কখনই থাকেনি। এত বড় একটা অভিযোগ যখন করাই হলো এরও ইতিহাস আছে নিশ্চই! আসুন সে ইতিহাসে একটু পায়চারি করে আসি।

এই ভূখণ্ডের মানুষ সম্রাট আকবর আসার আগেও চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থান বুঝেই তাদের প্রাত্যহিক কর্ম সিদ্ধান্ত নিতো। গ্রহ নক্ষত্র ভিত্তিক যে বর্ষপঞ্জীটি তারা অনুসরণ করতো তার নাম “শকাব্দ”। জানা যায়, সেটি মৌর্য আমল থেকে প্রচলিত। আকাশের কোন নক্ষত্রটি কোন অবস্থানে থাকবে তা অনুদণ্ড পল হিসেব করতে নক্ষত্র বিজ্ঞানের প্রয়োজন এবং প্রাচীন ভারতবর্ষ যে নক্ষত্রবিজ্ঞানে প্রাজ্ঞতার সাক্ষর রেখেছে হাজার হাজার বছর আগে তাতো বিজ্ঞানের ইতিহাসই বলে! (দাঁড়ান, ভারতবর্ষ শুনে পালাচ্ছেন কেন? অঙ্গ-বঙ্গ অথবা মগধের ইতিহাসে আপনার, আমার সকলের পূর্বপুরুষই আছে, প্রাচীন ভারতবর্ষের উত্তরাধিকার আপনার আছে, আছে বলেই হিন্দুয়ানীকে গালিদেয়া ওয়াজটি অহিন্দু ভাষায় কুলিয়ে উঠতে পারা যায় না)

যাই হোক, যেখানে ছিলাম। কেমন সেই নক্ষত্র বিচার দিয়ে করা বর্ষপঞ্জী? উদাহরণ দেই। এই যেমন: ২৯ চৈত্র, ১৩ এপ্রিল, ৭ শাবান, আজ শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি (যার মানে আর সাত দিন পর পূর্ণিমা)। পুনর্বসুনক্ষত্রটি রাত দুইটা এক মিনিট তেতাল্লিশ সেকেণ্ড থেকে ভোর ৬ টা ৪১ মিনিট ৩০ সেকেণ্ড পর্যন্ত পৃথিবীর সাথে উপবৃত্তাকারে অবস্থান করবে এবং তারপর আসবে পূষ্যানক্ষত্রের পালা। নক্ষত্র আর গ্রহের এই অবস্থান থেকে শুধু বাংলা মাসের নাম আসেনি, বাংলা দিন এর নামও এসেছে। মিলিয়ে দেখুন। পহেলা বৈশাখকে না হয় হিন্দুয়ানী বলে এড়াবেন, কিন্তু শুক্র বা শনিবারকে এড়াবেন কী করে?

এই নক্ষত্রের গ্রহের অবস্থান ভিত্তিক বর্ষগণনা পদ্ধতি কি হাজার বছর ধরে অবিকৃত? না। বহুবার এর সংস্কার হয়েছে, নক্ষত্র বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে ভুল সংশোধন করা হয়েছে প্রয়োজন মত। এই মুহুর্তে যে নক্ষত্রভিত্তিক বর্ষপঞ্জীটি ব্যবহৃত হচ্ছে তার বয়স ১৯৪১ বছর। অর্থ্যাৎ আজ শকাব্দ ১৯৪১, বঙ্গাব্দ ১৪২৬ আর হিজরী ১৪৪১. অর্থ্যাৎ সংশোধিত এই বর্ষপঞ্জিটি হিজরী সাল প্রবর্তনের ৫০০ বছর আগের। সম্রাট আকবর যে ফসলি সালটি সংস্কার করেন তার বয়স ১৪২৬ বছর, সেটা আসলে শকাব্দ আর হিজরী সাল মিলিয়ে। অর্থ্যাৎ বর্তমানে যে বিশুদ্ধ পঞ্জিকায় বাংলা বছরটি অনুসরণ করা হয়, তা হিন্দুর একার নয়, ওতে হিন্দু মুসলিম দুইয়েরই ভাগ আছে। 

আপনি হয়ত ভাবছেন যে, হিন্দু মুসলিম দুইয়ের যদি হবে? তবে কাল বাংলাদেশের হিন্দুরা কেন পহেলা বৈশাখ পালন করবেনা? এরও আছে গল্প, ১৯৫২ সালে পশ্চিমবাংলার সরকারের অনুরোধে মেঘনাদ সাহা বাংলা বর্ষপঞ্জীর সাথে শকাব্দের সমন্বয় আরো সংশোধন ও সূ²তানয়ন করেন। ১৯৬৩ সালে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও বাংলা সাল গণনায় কিছু সংস্কার করেন। যেমন, নক্ষত্র ভিত্তিক দিন গণনার পদ্ধতিতে একটি মাস ৩২ দিন ও হতে পারে। যেমন শ্রাবণ মাস প্রায়ই ৩২ দিনের হয়,  শ্রবণা নক্ষত্রের আয়তনের কারণে পৃথিবীর সাথে তার সরণে সময় লাগে বলে। আবার পূষ্যা নক্ষত্রের সরণ ভেদে পৌষমাস ২৯ দিনেরও হয়। তবে বছরের মোট দিন ৩৬৫-ই থাকে। কোন বছর কোন মাস কতদিনের হবে তা নক্ষত্রের পল দণ্ড অবস্থান বুঝেই হিসেব করা হয়। এই কারণেই হিন্দু বাড়িগুলোতে আজও ঠিক ক্যালেন্ডারে চলে না, একটি পঞ্জিকাও প্রয়োজন।

কিন্তু ভাষাবিদ ডক্টর শহীদুল্লাহ্ এই নক্ষত্রভিত্তিক চর্চাটি অস্বীকার করে যে, বাংলা ক্যালেন্ডারটি করেন, তাতে শুধুমাত্র হিসাবের সুবিধার জন্য বাংলা বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনের আর আর পরের সাত মাস ৩০ দিনের হবে বলে ঠিক করেন। অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে মাথা ঘামাবার আর প্রয়োজন নেই। গ্রেফ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার এর নীচে আংগুল এর করগুণে বাংলা তারিখ বসিয়ে দেয়া। তাতে যে বাংলা পঞ্জিকা মেনে চলা মানুষগুলোকে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে, তা আর কারোর মাথাতেই এলো না। ভাষাবিদ মহাশয়ও নন। তখন তো আর সংখ্যায় ৫% ছিলনা তারা। তবু ভাবেনি। কারণ পাকিস্থান বা বাংলাদেশ, কেউই তার সংখ্যালঘুদের ভাবার কথা নিজের শেকড়ে অনুভব করেনি কোনকালেই।

কাহিনী এখানেই শেষ নয়। পাকিস্থানি আমলে ৬৩ সালের সংশোধিত বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে খুব বড় প্রভাব না দিলেও বাংলাদেশ সরকার ডক্টর শহীদুল্লাহর ক্যালেন্ডারটিই নিলেন। আর ১৯৯৫ সালে ঠুকে দেয়া হল শেষ পেরেক। সরকার এর পরামর্শ নিয়ে বাংলা একাডেমি শুধু বাংলা ক্যালেন্ডার আরেকবার সংস্কার করলেন যাতে ইংরেজি ঐতিহাসিক তারিখ এর মত বাংলা তারিখ ও নির্দিষ্ট করে দেয়া হল। ফলে কী সর্বনাশটা হলো জানেন? আপনি যখন কবিতায় পড়ছেন যে ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার ওয়াক্ত আর সেদিন ছিল ফাল্গুনের আট তারিখ, ১৯৯৫ এর ক্যালেন্ডারে তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো যে, ২১ ফেব্রুয়ারি মানে ৯ ফাল্গুন। পহেলা বৈশাখ মানে ১৪ এপ্রিল, এটাই নির্দিষ্ট। পলিটিক্স বুঝলেন কিছু?

অতএব, গত চৌদ্দ এপ্রিল যারা পহেলা বৈশাখ পালন করতে করেছেন তারা নির্ভয়ে থাকুন। আপনারা যে দিনটি পালন করলেন তা নির্ভেজাল মেডইন পাকিস্থানি ও এসেম্বেল্ড ইন বাংলাদেশ। হিন্দুরা পনের সেদিন চৈত্র সংক্রান্তি পালন করেছে। পাজন খেয়েছে, চৌদ্দ শাক খেয়েছে, আট পদের ফলার খেয়েছে, সকালবেলা বিষকাটালির ডাল পুড়িয়ে বলেছিলো পুরাতন বছরের সাথে সাথে দুনিয়ার সব অশুভ শক্তি দূর হোক! নতুন বছরে মঙ্গল হোক জগতের।

কারণ, ওদিন অশ্লেষানক্ষত্র পৃথিবীর সাথে দক্ষিণ কোণে ৫৪ পল ২১ অনুপল ও ৫৩ দণ্ডে রাত্রি ৩ টা ৩৬ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড পর্যন্ত অবস্থান করার পর রেবতী ও বৈশাখ নক্ষত্রের অমৃত যোগে ১৯৪১ শকাব্দের ১৪২৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখমাসের প্রথম দিনটি শুরু হয়েছে। কিন্তু সে হিসেব নিয়ে চিন্তিত হবার কোনই কারণ নেই আপনার। আপনি বরংচ নির্ভাবনায় সম্রাট আকবর, মেঘনাদ সাহা ও প্রাচীন নক্ষত্রবিজ্ঞানের হিন্দুয়ানী স্পর্শ মুক্ত খাঁটি বাংলাদেশী বাংলা নববর্ষই পালন করুন। 

দ্বিজাতীতত্বের যে আবর্জনা আপনাদের মগজে আপনারা জন্ম থেকে লালন করে আসছেন ওটা অত সহজে পরিস্কার হবার বিষয় নয়। দুলাল চক্রবর্তীর রথযাত্রায় যাওয়া আর সৈয়দ দুলালের মহানবীর জন্মদিন পালন দিয়ে যারা জাতীয়তাকে খণ্ডিত করে তাদের মগজের দেউলিয়াপনাটা তাদের একান্তই নিজেদের। মানুষের পরিচয় টিকি বা টুপি দিয়ে হয়নি কখনো; বরংচ মনুষত্বের পরিচয়টা প্রকাশের জন্য ওই পোশাকী পরিচয়টা অন্তরালে নেয়াই মানবিকতা আর প্রগতিশীলতার পরিচয়। সেজন্য আপনাকে আরো জানতে হবে, পড়তে হবে, বুঝতে হবে, চর্চা করতে হবে; সর্বোপরি মনের বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে হবে। তবেই পাবেন সাংস্কৃতির আসল স্বাদ। 

একটা বিষয় আরেকটু পরিস্কার হওয়া ভালো- আপনি কতটা নাটক করেছেন বা কতটা আবৃত্তি পারদর্শী তা দিয়ে আপনার সাংস্কৃতিমনস্কতা মাপার কোন প্যারামিটার এখনো আবিস্কার হয়নি। বরংচ আপনার শোঅফ করা সাংস্কৃতির অন্তরালে যে সাম্প্রদায়িকতার কালো অন্ধকার সেটা কোন-না কোনভাবে ঠিকই ধরা পরে। 


তথ্যসূত্র:
১। সোনম সাহা, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
২। বঙ্গাব্দের উৎস কথা- সুনীল কুমার বন্দোপাধ্যায়
৩। বাঙলা সনঃ বঙ্গ, বাঙালা ও ভারত- ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
 


এসএমএইচ
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ