ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫

Motobad news
শিরোনাম

চারণ কবি মুকুন্দ দাসের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

চারণ কবি মুকুন্দ দাসের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে,/ মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।/ তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমী দ্রিমী দং দং/ ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।/ দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী,/আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে।/ সাজ রে সন্তান হিন্দু মুসলমান/ থাকে থাকিবে প্রাণ না হয় যাইবে প্রাণ। /লইয়ে কৃপাণ হও রে আগুয়ান,/ নিতে হয় মুকুন্দ-রে নিও রে সঙ্গে। জাগরণের গান। যার এমন গানে উত্তাল হয়েছিল বাংলা তিনি চারণকবি মুকুন্দ দাস।

‘হাসি হাসি পরবো ফাঁসী/ দেখবে জগৎ বাসী,/একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।’ ক্ষুদিরামের ফাঁসী উপলক্ষে রচিত এই অমর গানের স্রষ্টাও কবি মুকুন্দ দাস। ব্রিটিশবিরোধী জাগানিয়া এমন সব গণসংগীত আজও প্রাণ ছুঁয়ে যায় মুক্তচিন্তার মানুষের। মুকুন্দ দাস এমন অনেক গান বানিয়ে, গান শুনিয়ে যেমন আন্দোলিত করেছিলেন স্বদেশিদের, বিপ্লবের ঝান্ডায় রসদ জুগিয়েছিলেন কবিতা নাটক যাত্রাপালায়, তেমনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। উপমহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি।
 
১৯৩৪ সালের ১৮ মে গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে তিনি মারা যান। অন্ধ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে দেশ মাতৃকার সাধনায় জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা চারণ কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তার পূর্বপুরুষেরা বিক্রমপুরের হলেও তিনি শৈশব থেকেই বেড়ে ওঠেন বরিশালে। বরিশালের মানুষ হিসাবেই নিজেকে পরিচিত করেছেন। কুড়ি বছর বয়সে কোনোরকম সার্টিফিকেট ছাড়াই পড়ালেখার ইতি টানেন মুকুন্দ দাস। পারিবারিক নাম ছিল যজ্ঞেশর দে। পড়ালেখায় মন ছিল না। বাবা তাকে বলে কয়ে দোকানদারিতে বসিয়ে দেন। এসময় পরিচয় এক গানের দলের সঙ্গে। যুক্ত হন ওই দলের প্রধান সহায়ক হিসেবে। কীর্তনিয়া হিসাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে নামডাক। কীর্তন গানের পাশাপাশি নিজে গান লিখে গাইতে শুরু করেন। এভাবেই বেড়ে ওঠা মুকুন্দ দাসের।

তখনো ‘মুকুন্দ’ নাম প্রচারিত হয়নি। সবাই ডাকে ‘যজ্ঞা’। কীর্তনের আসরে, গানের আসরে ডাক পড়ে। এর মধ্যেই ১৯০০ সালে ২২ বছর বয়সে বিয়ে করেন। এর পরপরই রামানন্দ ঠাকুরের কাছে দীক্ষা নেন। তিনিই তার নাম রাখেন মুকুন্দ দাস।

১৯০৩ সালে বরিশাল আদর্শ প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় মুকুন্দ দাসের প্রথম বই। নাম, ‘সাধনসঙ্গীত’। বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্তের সংস্পর্শে রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন মুকুন্দ দাস। এ সময় থেকে বিপ্লবী অশ্বিনীকুমার দত্তের সঙ্গে তার সম্পর্ক গুরু-শিষ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়। স্বদেশিকতার চর্চা এখান থেকেই শুরু এবং মুকুন্দ দাস ক্রমেই বৈষ্ণব ধারণা থেকে সরে আসতে থাকেন।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বরিশালে তুমুল ইংরেজবিরোধী বিক্ষোভ দেখা দেয়। মুকুন্দ দাস নিজে এই বিক্ষোভে অংশ নেন ও ইংরেজবিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করে এবং একের পর এক গান, কবিতা ও নাটক রচনা করে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে নূতন উদ্দীপনার সঞ্চার করেন।

১৯০৪সালের দিকে কালিসাধক সোনাঠাকুর দ্বারা প্রভাবিত হন মুকুন্দ দাস। ১৯০৫ সালে রচনা করেন প্রথম পালাযাত্রা ‘মাতৃপুজা’। যাত্রার মধ্য দিয়ে স্বদেশি আন্দোলনের ধারাকে আরও জাগরিত করেন। ওই যাত্রাপালার পান্ডুলিপি বাজেয়াপ্ত করে তৎকালীন পুলিশ। যাত্রাদল গড়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে থাকেন তিনি । যাত্রা থামিয়ে মাঝেমধ্যেই বক্তৃতার ঢঙ্গে সমকালকে তুলে ধরেন। মুকুন্দ দাসের যাত্রাপালা ও গান ব্রিটিশ শাসকের ভীতির কারণ হয়ে ওঠে।

ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে ১৯০৮ সালে গ্রেপ্তার হন মুকুন্দ দাস। জেল খেটে ১৯১১ সালের প্রথমভাগে দিল্লি কারাগার থেকে ছাড়া পান। এর মাঝেই স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। জেলফেরত মুকুন্দ অল্প ব্যবধানে আবার তিনি বেড়িয়ে পড়েন গান-যাত্রাপালা নিয়ে মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে বিপ্লবীর বেশে।

ভারতবর্ষের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। দেশবন্দু চিওরঞ্জন দাস, প্রিয়ম্বদা দাস, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু তার গানে মুগ্ধ। নজরুল এসে দেখা করেন তার সঙ্গে। তিনি তাকে গান গেয়ে শোনান ও তার লেখা কয়েকটি বই উপহার দেন। মুকুন্দদাসের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মাতৃপূজা, সমাজ, আদর্শ, পল্লীসেবা, সাথী, কর্মক্ষেত্র, ব্রহ্মচারিণী, পথ ইত্যাদি।

এ সময়ে বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি বরিশালের কাশীপুর কালীমন্দিরের জায়গা কেনেন। যা এখন বরিশালে চারনকবি মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি নামে পরিচিত। এখানে রয়েছে ছাত্রাবাস, লাইব্রেরি, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং পুজামন্দির। মুকুন্দ দাসের স্মৃতিরক্ষায় এখন ওইটুকুই বরিশালে সবেধন নীলমনি হয়ে আছে।


এমইউআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ